গরুর মাংসের দামে এত তফাৎ কেন?

13

এম এ হোসাইন

গরুর মাংস কম দামে বিক্রি করে আলোচিত হয়েছেন ঢাকার শাহজাহানপুরের ব্যবসায়ী খলিল। ৬০০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করছেন তিনি। ঢাকার বাজারে এতো কম দামে গরুর মাংস বিক্রি হলেও চট্টগ্রামে বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশি দামে। হরেক রকম দামে চট্টগ্রামের বাজারে বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। মূলত ৮শ থেকে সাড়ে ৯শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। ঢাকার বাজারের চেয়ে চট্টগ্রামের বাজারে কেজিপ্রতি তফাৎ ৩০০ টাকা। দামের এমন পার্থক্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা। তারপরও চট্টগ্রামের কোন ব্যবসায়ী বা সংগঠন ন্যায্যমূল্যে গরুর মাংস বিক্রির উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসছেন না।
রোজা সামনে রেখে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাতেও অস্থায়ী গরুর মাংসের দোকান দিয়েছেন অনেকেই। স্থানীয়ভাবে টাকা তুলে গরু কিনেছেন কয়েকজন। বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হচ্ছে এই ভাগা মাংস। স্থানীয় লোকজনের কাছে কিছুটা কম মূল্যেই এসব দোকানে মাংস বিক্রি হচ্ছে। যেখানে মাংসের দাম পড়ছে কেজিপ্রতি সাড়ে ৬শ থেকে সাড়ে ৭শ টাকার মধ্যে। মাংসের দামের এমন হেরফেরে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না ক্রেতারা। রমজানের মাংসের চাহিদা বেশি থাকে। বেশি বিক্রি হওয়ার পরও দামে কম রাখছেন না মাংস ব্যবসায়ীরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজারে সরবরাহ বাড়াতে না পারলে গরুর মাংসের দামে অস্থিরতা দূর করা কঠিন হবে।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, গরুর মাংসের একটা যৌক্তিক দাম থাকা দরকার। ঢাকার বাজারে ৬০০ টাকা আর চট্টগ্রামের বাজারে ৯০০ টাকা এটা কোন অবস্থাতেই মানা যায় না। সরকারের দাম নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। একইসাথে বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতিও ভাল থাকা জরুরি। রমজান মাসে ব্যবসায়ীদেরও মনোভাব পরিবর্তন হওয়া দরকার।
চট্টগ্রামে কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করে আলোচনায় এসেছিল ‘মিট বাজার’ নামে একটি ফেসবুক গ্রæপ। নগরের অক্সিজেন বালুছড়া এলাকায় কেজিপ্রতি ৫৮০ টাকা দামে মাংস বিক্রি শুরু করেন তারা। গরু কিংবা মহিষ পাওয়া সাপেক্ষে সপ্তাহে একদিন মাংস করে মিট বাজার। সর্বশেষ গত শুক্রবার কেজিপ্রতি ৭২৫ টাকা দরে মাংস বিক্রি করেছিল মিট বাজার।
মিট বাজারের ক্যাশিয়ার বেলায়েত হোসেন রিয়াদ বলেন, আমরা গরু বা মহিষ পাওয়া সাপেক্ষে শুক্রবার মাংস বিক্রি করি। ফেসবুকে সেটা জানিয়ে দেওয়া হয়। বেশি বিক্রি হলে দামও কম রাখা যায়। আমরা দৈনিক ৫০/৬০মন পর্যন্ত মাংস বিক্রি করেছি। ঢাকায় যে দামে মাংস বিক্রি করছে, সে দামে চট্টগ্রামে সম্ভব হবে না। তবে বেশি বিক্রি হলে বাজার মূল্য থেকে অনেক কম দামে মাংস বিক্রি করা সম্ভব হবে। চট্টগ্রামের বাজারে সাধারণত হাড়সহ ও হাড় ছাড়া দুইভাবে গরুর মাংস বিক্রি হয়। তুলনামূলক বেশি দাম থাকে হাড়ছাড়া মাংসের। বাজারে প্রতি কেজি হাড় ছাড়া (সলিড মাংস) গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৯৫০ টাকায়। রমজানের আগেও হাড়ছাড়া মাংস বিক্রি হয়েছিল ৯০০ টাকা কেজি ধরে। হাড়সহ মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮শ থেকে সাড়ে ৮শ টাকা দরে। হাড়সহ মাংসের মধ্যে সাধারণত সলিড মাংস ৭০০ গ্রাম এবং ৩০০ গ্রাম হাড় ও চর্বি থাকে। যদিও বাস্তবে হাড় ও চর্বির পরিমাণ আরও বেশি থাকে। দুই মাস আগেও গরুর মাংসের দাম অনেক কম ছিল। জাতীয় নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের বাজারে গরুর মাংসের দাম হঠাৎ করে কমে গিয়েছিল। হাড়ছাড়া গরুর মাংস সাড়ে ৭শ থেকে ৮শ টাকায় এবং হাড়সহ গরুর মাংস ৬৮০ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। নির্বাচনের পর থেকে আবার দাম বাড়তে থাকে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামের বাজারে ২০২১ সালের মার্চে গরুর মাংসের দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৫৬০ টাকা। পরের বছর একই মাসে তা ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা হয়ে যায়। গত বছর এই সময়ে বাজারের হাড়সহ গরুর মাংসের দাম ছিল গড়ে ৭৫০ টাকা ও হাড় ছাড়া ৯০০ টাকা। প্রতিবছর রোজার অন্তত এক মাস আগে বাজারে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে গরুর মাংসের দাম।
বহদ্দারহাট বাজারে কথা হয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, গরুর মাংসের দাম বেশি বেড়েছে। হাড়ছাড়া মাংস সাড়ে ৯শ টাকার নিচে দিচ্ছে না। হাড়সহ সাড়ে ৮শ টাকা। রমজানে ঢাকায় ৬০০ টাকায় মাংস বিক্রি হচ্ছে। একই পণ্যের দামে ঢাকা-চট্টগ্রামে কেজিপ্রতি তফাৎ প্রায়সাড়ে তিনশ টাকা। এমনটা হওয়া কোন অবস্থাতেই উচিত নয়।
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে রমজানের আগেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে একটি চিঠি দেয় ক্যাব। ক্যাবের সেই চিঠিতে বলা হয়, দেশের বৃহত্তম সিটি কর্পোরেশন ও বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে অনিরাপদ খাদ্যের ভয়াবহ প্রসার ও ভোক্তা অধিকার লঙ্গনের ঘটনা প্রতিনিয়তই বেড়েই চলেছে। একই সাথে খাদ্য-পণ্যের সাথে জড়িত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মজুতদারদের অপতৎপরতায় খাদ্যপণ্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মানুষ খাদ্যের তালিকায় বাধ্য হয়ে কাটছাড় করতে বাধ্য হচ্ছেন। খাদ্য নিরাপত্তা প্রচন্ড হুমকির সম্মুখিন। পবিত্র মাহে রমজান সমাগত। রমজান আসলেই কিছু খাদ্য মূল্যসন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তারা খাদ্যে, ভেজাল ও ওজনে কম দেবার পাশাপাশি অতিমুনাফার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। যদিও মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশেই রমজানে মূল্যছাড়সহ নানা আয়োজন হয়। এছাড়াও সাধারন মানুষের অতি প্রযোজনীয় প্রোটিনের উৎস গরুর মাংসের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারনে মানুষ গরুর মাংস কেনা বন্ধ করে দেন। এছাড়াও মাংসের দোকানে অপরিষ্কার, অপরিছন্ন পরিবেশে মাংশ বিক্রিসহ পুরো বাজারের নোংরা পরিবেশ মানুষকে বাজার বিমুখ করেছে। যা আমাদের সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে মারাত্মক প্রতিবন্ধক।