গবেষক জামাল উদ্দিনের ‘আনোয়ারা একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’

125

বাংলাদেশ। আমার দেশ, আমাদের দেশ। প্রাণের দেশ, প্রিয় দেশ। আমাদের জন্মভূমি, মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এমনে এমনে এই বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। এই দেশের জন্ম, এই দেশের স্বাধীনতা, লাল সবুজের পতাকা আমরা পেয়েছি একাত্তর সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এইদেশীয় দোসর দালালদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করে দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। একাত্তরে সাত লক্ষ বাঙালি প্রায় অধিকাংশই মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। অল্পকিছু মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের বিরোধীতা করেছিল ; তারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি হত্যা করেছে, নয়তো হত্যায় সহযোগিতা করেছে। লক্ষ লক্ষ বাড়িঘর পুড়িয়েছে, বুদ্ধিজীবি হত্যা করেছে, সম্পদ নষ্ট করেছে, মা-বোনদের ইজ্জত ছিনিয়ে নিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁদেরকে আমরা বীর মক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিনি। তাঁদেরকে আমরা প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসি, সম্মান করি এবং সম্মান করবো আজীবন।
পাশাপাশি যারা স্বাধীনতা বিরোধী ছিল তাদেরকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করবো আজীবন। ঘৃণা করতে না-পারলেও অন্তত তারা যেন রাষ্ট্রের, সমাজের ও স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে নেতৃত্বে আসতে না-পারে সেটাই কাম্য। সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশেষ করে পচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিএনপি, জামাতের রাজনীতির মাধ্যমে নেতৃত্বে এসে স্বাধীনতা বিরোধীরা জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। টানা একুশ বছর স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকায় স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে দীর্ঘ সময়-সুযোগ পেয়েছিল।
এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লেখা কঠিন দুঃসাহসিক ব্যাপার। কারণ, ইতিহাস লিখতে হলে কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলো সেটা যেমন ওঠে আসবে, তেমনি কারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো সেটাও ওঠে আসবে। ইতিহাসে ইতিবাচকভাবে সম্মানের সহিত স্থান পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা যারা ছিলেন তারা তো আনন্দিত এবং গর্বিত হবেনই। যারা বেঁচে নেই তাঁদের পরিবারের সদস্যরা গর্ববোধ করেন। বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, ‘আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’। কিন্তু, যারা সেদিন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, রাজাকারী করে ছিল, তারা তাদের নাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় উঠুক সেটা কখনোই চাইবে না। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কখনো কখনো। ফলে সত্য ইতিহাস লেখার জন্য লেখকের জীবন নানাভাবে হুমকির মধ্যে পরে। রাজাকার পরিবারের প্রভাবশালী প্রতাপশালী সদস্যদের চোখের কাঁটা হয়ে যায় লেখক। একটা অঞ্চলের ইতিহাসে একজন দুজন নয়, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অনেকগুলো মানুষের নাম এসে যায়। তাদের মধ্যে অনেকের সন্তান এখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত। তারা এখন ধনে-মানে-পদে ক্ষমতাশালী। এই ক্ষমতাশালীদের নাম বা তাদের পিতার নাম ইতিহাসের পাতায় নেতিবাচক ভূমিকা রাখাদের তালিকায় লেখা বিশাল সাহসীক ব্যাপার। এটা লিখতে একজন লেখকের জীবনের মায়া ত্যাগ করে লিখতে হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিখতে হয়।
এই দুঃসাহসিক কাজটি করেছেন লেখক-গবেষক জামাল উদ্দিন। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ ‘আনোয়ারা একাত্তরের গনহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি পড়ে মনে হয়েছে জামাল উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস লেখার কাজে স-নিয়োজিত বর্তমান সময়ে দেশের দুঃসাহসিক লেখকদের একজন। আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই বই অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল। আগামী প্রজন্মের জন্য ও ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর যারা গবেষণা করবেন তাদের জন্য জামাল উদ্দিনের এই বই গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে।
‘আনোয়ারা একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইটিতে উল্লিখিত তথ্যগুলোর সত্যতা নিশ্চিতও হয়েছি আমি ; বইটি পাঠকালে। বইটি পাঠকালে আমার বয়স্ক এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আমার বাড়িতে ছিলেন। সেদিন রাতে তিনি আমাদের বাড়ি থাকাকালীন ওনার এক আত্মীয় মারা যাওয়ার খবর পান। পরে রাতে খাবার টেবিলে গল্পে আলাপে তিনি জানান আজ যে মহিলার মৃত্যু হয়েছে তার স্বামীকে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলেছিল। কীভাবে কোথায় কখন মেরেছে সরল মনা আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া সবই বললেন বিস্তারিত। পরক্ষণে আমি আনোয়ারা একাত্তরের গনহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বইটি খুলে তথ্যটি মিলিয়ে দেখলাম, হুবহু মিল আছে। এই বইয়ে আছে ওনার আরেক আত্মীয়ের কথা। যাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিনি আমরা। বইয়ে আছে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অর্ধেক সময়ে এসে যুদ্ধ থেকে বিরতি দিয়েছিলেন। আমি তার কাছে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করলাম। এই তথ্যেরও শতভাগ সত্যতা পেয়েছি। এই দুইটা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ্য করলাম এখানে। তবে তাদের নাম-পরিচয় এখানে উল্লেখ্য করলাম না। পাঠক হিসেবে নিজে এই গ্রন্থের পাতায় রচিত ইতিহাসের সত্যতা আমি পেয়েছি- সেটাই বলছি। আনোয়ারা উপজেলায় এই গ্রন্থ ব্যাপক পাঠকপ্রিয় একটি বই। সত্য ইতিহাস প্রিয় সর্বজনের কাছে সমাদৃত হয়েছে বইটি। মাঝেমাঝে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী কারো সন্তান রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনে কোনো পদ-পদবীতে আসলে ‘আনোয়ারা একাত্তরের গনহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ের পাতা স্যোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করে সচেতন নাগরিক। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের ও তাদের পরিবারের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
আমাদের পাড়ায় এক বিধবা দাদী আছেন। তাঁর স্বামী (আবদুল মোনাফ, বৈরাগ গ্রাম) মারা গিয়েছিলেন আশির দশকের মধ্যভাগে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি মৃত্যুর আগে, বা তখন সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু হয় নি। কোনটা ঠিক জানি না। তবে উনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সেটা আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মনসুর চৌধুরীসহ অনেকের কাছে জেনেছি। আর সর্বশেষ জেনেছি ‘আনোয়ারা একাত্তরের গনহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি পড়ে। যদিও আমাদের পাড়ার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোনাফের বিধবা স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তো দূরের কথা বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী মৃত্যুর পর দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর অভাবে অনটনে দিন যাপন করলেও পান না বয়স্ক ভাতা বা বিধবা ভাতা। কোনোটাই না।
এই বইটি পড়েই আমরা সবিস্তারে জেনেছি বন্দর গ্রামে গণহত্যার কথা। যেখানে একদিনে একই স্থানে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২১২ জন নিরীহ মানুষ। পরৈকোড়া-পূর্বকন্যারা ও বাথুয়াপাড়ায় গণহত্যার কথাসহ সুরমা পুকুর পাড়ে গণহত্যার কথা জেনেছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীকে রাজাকার বাহিনীরা কী নির্মমভাবে হত্যা করেছে তা পড়লে পাঠকের মনে অবধারিতভাবে আরেকবার ঘৃণা জন্মাবে রাজাকারদের প্রতি। হত্যার পরদিন সুরমা পুকুর পাড়ের কবর থেকে শহীদ রুস্তম আলীর মৃতদেহ তুলে নিয়ে আনন্দ উল্লাস করেছিলো আনোয়ারার নেতৃস্থানীয় রাজাকাররা। আহ! সে-সব কথা পড়লে একাত্তরের গণহত্যা ও নির্মমতা সম্পর্কে যে কোনো পাঠক ধারণা পাবেন।
মুক্তিযুদ্ধের ওপর বাংলাদেশে উপজেলা ভিত্তিক আর কোনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ আছে কি না জানি না। তবে চট্টগ্রাম তথা দেশে এইটাই প্রথম উপজেলা ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ বলে আমার মনে হয়। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ২০০৬ সালে তাঁর প্রথম বই ‘দেয়াঙ পরগণার ইতিহাসের’ অংশবিশেষ হিসেবে। পরবর্তীতে ২০১০ সালে, ‘আনোয়ারা একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ নামে আলাদা বই হিসেবে প্রকাশিত। এই অসাধারণ বইটির জন্য গবেষক জামাল উদ্দিন ইতিহাস প্রিয় মানুষের কাছে বেঁচে থাকবেন যুগ-যুগ ধরে। যদিও জামাল উদ্দিন আরো অনেক মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থের লেখক।
এই গ্রন্থ নিয়ে লেখার এক পর্যায়ে এসে গবেষক জামাল উদ্দিনের সাথে আলাপে জানতে পেরেছি-সত্যিই এই বইটি প্রকাশের পর প্রভাবশালী রাজাকার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তিনি বহু হুমকি ধামকি পেয়েছেন। এমনকি প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে এক পর্যায়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল সেই সময়। বই প্রকাশের দেড় দশক পরে এসেও বিভিন্ন সময়ে রাজাকার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আড়ালে আবডালে নানা কটুবাক্য শুনতে হয় তাঁকে। কিন্তু, কোনো রক্তচক্ষুর ভয়ে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস লেখায় কখনো ধমে যান নি সত্যানুসন্ধানী লেখক জামাল উদ্দিন। তাই তো আলোচিত গ্রন্থটি ছাড়াও মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ লিখতে পেরেছেন তিনি। তাঁর হৃদয়ে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুরাগ গড়ে ওঠে সেই মহান একাত্তরেই। একাত্তরে আনোয়ারা হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া জামাল উদ্দিনের মনে গভীর রেখাপাত করে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা জামাল উদ্দিন চরমভাবে ব্যতিত হয়েছিলো পচাত্তরের পনেরো আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায়। সেই থেকে তিনি বরাবরই বয়কট করে আসছেন রাজাকার, আলবদর সহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল জামাত-শিবিরের রাজনীতি করা মানুষদের। জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখেন তিনি অনেক বছর ধরে।
মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ চট্টগ্রাম কমান্ডার সার্জেন্ট মহিউল আলমের মতো হারিয়ে যেতে বসা অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ইতিহাস জনসম্মুখে এনেছেন তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। এজন্যেও তিনি প্রশংসার দাবিদার। মুক্তিযুদ্ধের ওপর জামাল উদ্দিনের গবেষণা থেমে নেই এখনো। মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস অনুসন্ধানে তাঁর নিরন্তর পথচলা দেখে অভিভূত হই খুব। তাঁর মতো দুঃসাহসিক লেখক-গবেষক আছেন বলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পেয়েছি এবং আগামীতে আরো পাবো।