খুদে মুক্তিযোদ্ধা

3

শিবুকান্তি দাশ

সারাদিন ঘরে থাকতে কার মন চায় বলো? একটু খেলাধুলা করতে না পারলে মনটা তো ফ্যাকাসেই হয়ে থাকে। সৈকতের হলো তেমনি অবস্থা। বাবার অফিসও বন্ধ। সারাদিন ঘরেই থাকেন। বন্ধুদের সাথে গিয়ে একটু মিশবে তার আর উপায় নেই। একটু এদিক ওদিক হলেই শাসন। সন্ধ্যা হলেই গুরুম গুরুম গুলি বোমার শব্দ। মাঝে মাঝে ঘরে থাকাই দায়। এমন গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে মনে হয় কাছাকছি কোথাও ভীষণ যুদ্ধ চলছে। মানুষের আর্তচিৎকার কানে আসে। মাঝে মাঝে দুরে আগুনের লেলিহান শিখা আকশের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। একটু জানলার ধারে গেলেই বাবা মার ধমক। বলছি না জানলা খুলবে না? যুদ্ধ শুরুর কয়দিনে সৈকতের মনটা বিষিয়ে উঠছে। কোথাও বেরুতে পারছে না, কোথাও বেড়াতেও যাওয়া হচ্ছে না। কিছুদিন আগে মা বলেছিল দাদাবাড়ি যাওয়ার কথা। অনেকদিন দাদাবাড়ি যাওয়া হয় না। সেই যে গ্রীস্মের বন্ধে গিয়েছিল। এখন যেনো সে কথা ভুলে গেছেন মা। অথচ ইশকুল বন্ধ। ঘরে বন্ধি হয়ে থাকার কোনো মানে আছে ? সৈকত এসব কথা নিজে নিজেই বিরবির করে বলে যায়। অফিস বন্ধ থাকায় বাবা এখন সকাল সন্ধ্যা রেডিও নিয়ে বসে থাকে। খবর শুনে আর পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে পড়া। সকাল দুপুর বিকেল গড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে হুট করে বাইরে বেরিয়ে যান, ফিরে আসে সেই রাতে। ঘরে ফিরে সৈকতের মার সাথে ফিসফাস করে কি যে আলাপ করে কে জানে। সৈকত সব কিছু ফলো করে। মাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে কি পরে বলব। ছোটোদেরকে সব কথা শুনতে হয় না। মা আমরা দাদাবাড়ি কবে যাবো ? কালকে তো রতনরা ওদের নানাবাড়ি চলে গেছে। হাসমতরাও নাকি ওদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। তুই এত খবর জানিস কি করে রে ? আবার বাইরে গিয়েছিলি ? তোকে না বারণ করছি। আমি তো বাইরে যাইনি। বিনু আপা জানালা দিয়ে আমাকে বলে গেলো। বিনু আসলো আবার কোন সময় ? দুপুরে। মা আমি দেখেছি। তুমি যখন রান্না ঘরে কাজ করতে ছিলে তখন। সৈকতের ছোট বোন টুনি হেসে হেসে বলল। গোমটার আড়ালে মা হাসে। একতলা বিল্ডিং এ ৬ টি পরিবার ভাড়ায় থাকে। চারটি পরিবার যুদ্ধ শুরুর পর থেকে চুপি চুপি চলে গেছে। কেউ জানে না। আছে এখন দুটো বাসা। সুমনরা আর সৈকতরা। সুমনের বাবা ইলিয়াস সাহেব ব্যবসা করেন। মহল্লায় বেশ পরিচিত তিনি। সৈকতের বাবার সাথে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। ঈদ কোরবানে যদি দেখা হয়। সেদিন হঠাৎ দুজন দুইদিক থেকে আসছিল। মুখোমুখি হতেই ইলিয়াস সাহেব মুচকি হেসে বলল, ভাইসাব ভয় নেই, ডরাইস না। আমি তো আছি। পাকিস্তানই থাকব। পাকিস্তান মানে ইসলামের হেফাজত। আপনি কি চাননা আমরা মুসলিমরা এক থাকি ? সৈকতের বাবা কিছু না বলে একটু হেসে বাসার দিকে পা বাড়ায়। দুইদিন আগে সৈকতের মেঝ কাকা আসছিল। উনি আবার পরদিন রাতে কোন সময় চলে গেছেন সৈকত দেখেওনি, জানেও না। মেঝকাকা আসার পরদিন মহল্লায় একটা গন্ডগোল হয়েছিল। দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে। একজনের অবস্থা নাকি ভালো নয়। ওরা নাকি পাকিস্তানের পক্ষে সেদিন মিছিল করেছিল। ইলিয়াস সাহেব সন্দেহ করছেন সৈকতের মেঝকাকাকে। এসবের কিছুই বুঝতে পারে না সৈকত। তবে যেটুক বুঝে দেশে কিছু একটা হচ্ছে। সবাই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কি হয় না হয়। এক ধরনের ভয় সৈকতের ছোট্ট মনেও। সন্ধ্যায় বাবা যখন বাসায় ফিরে সৈকত বাবার কাছে কাছে ঘুরঘুর করে। দাদাবাড়ি যাওয়ার কথা বলে কি না। মা তো অনেক আগে একবার বলেছিল। রান্না ঘর থেকে সৈকতের মা ড্রয়িং রুমে আসলে সৈকতের বাবা ফিসফিস করে বলে কাল সকালে খুব ভোরে গ্রামে রওনা করতে হবে। হঠাৎ এ কথা শুনে একটু ভরকে গেলেন তিনি। টুনি পড়তে বসেছে। অ আ ই ঈ সুর করে পড়ে যাচ্ছে। সৈকত একবার টুনির কাছে যায় আবার বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়। কি রে তুই ঘুরঘুর করছিস কেন ? এক জায়গায় বসতে পারিস না। বাবা বলল। দাদাবাড়ি কবে যাবো আমরা ? কাল ভোরেই রওনা করব। হাঁটতে পারবি তো ? গাড়ি তো বন্ধ। পারব বাবা। খুশিতে সৈকতের যেন লাফাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সব কিছু যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে। মেঝ কাকা দুইদিন আগে আসলো আবার কবে চলে গেলো। মহল্লায় গোলাগুলির ঘটনায় ইলিয়াস সাহেব কাকাকে সন্দেহ করছে। কোনটার সাথে কোনটা মিলাতে পারে না সৈকত। এত কাপড় চোপড় নিয়ো না সৈকতের মা। পথে কি হয় বলা যায় না। গাড়ি ঘোড়া বন্ধ। ভারী বোঝা নিয়ে চলা খুব কষ্ট হবে। বড় একটা ট্্রাঙ্কে মা বাবা কাপড় চোপড়, দরকারী জিনিষপত্র গোছাচ্ছেন। মা কিছুতেই বাবার কথা শুনতেছে না। টুনির দুটো খেলনা গাড়িও মা ট্রাঙ্কে নিতে চাইলে বাবা রেগে ওঠে। দুটো রিকসা গাড়িকে আগেই বলে রেখেছিল। খুব ভোরে আযানের আগে আগে সৈকতরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাবা ভারী ট্রাঙ্কটা রিকসায় তুলে। টিপিন ক্যারিয়ারটা হাতে নেয় সৈকত। টুনির ঘুম ভাঙ্গেনি। ও চোখ বন্ধ করে মার কাঁধে। অনেক কষ্টে ট্রেন ষ্টেশনে পৌছে। তখন ভোরের আলো ফোটেনি। ফাস্ট ট্রেনটাতে চড়বে সৈকতরা। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। আরো অনেক লোক জড়ো হয়েছে। ট্রেন আসবে কি না কেউ জানে না। লোকজন বলাবলি করতেছে, কোন জায়গায় নাকি ব্রিজ ভেঙে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। যাতে গোলাবারুদ নিয়ে মিলিটারিরা ঢাকা থেকে আসতে না পারে। হঠাৎ লোকজনের হইচই। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে এদিক সেদিক। দুইজন মিলিটারি ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে। পাঁচ ছয়জন গুন্ডা, লোকজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা, এটা সেটা কেড়ে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িওয়ালা দুইজন সৈকতের বাবার হাত থেকে ট্রাঙ্কটা ঝাপ্টা মেরে নিয়ে গেলো। কিছু বলতে যাবার আগেই একজন সৈকতের বাবাকে এমন জোরে চড় মারলো, তিনি ছিটকে দুইহাত দুরে পড়ে যায়। সৈকতের মা জড়িয়ে ধরে উনাকে। ওরা নাকি রাজাকার। বাবা রাজাকার কি ? এ সময় হুইসেল বাজিয়ে গম গম করে ছুটে আসে ট্রেন। যে যেদিক পারলো ট্রেনে উঠে পড়ে। সৈকতকে জানালা দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেয় বাবা। সেখানে মাকে দেখতে না পেয়ে ভে করে কেঁদে দেয় সৈকত। একটু পর বাবা মা দুইজনকে দেখে মন ভালো হয় সৈকতের। কিন্ত বাবাকে চড় মারলো যে লোকটা, তাকে রাজাকার বলল কেন তা মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে। সূয্য ডুবার আগে মুহূর্তে সীতাকুন্ডু ষ্টেশনে থামে ট্রেন। কোন গাড়ি ঘোড়া কিচ্ছু নেই। পায়ে হাঁটা তিন চার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে যেত হবে সেই সলিমপুর। অন্য সময় ষ্টেশনে গরুর গাড়ি অপেক্ষা করতো। সৈকতের দাদা ব্যবস্থা করে রাখতেন। যুদ্ধের ডামাডোলে সবাই পালিয়েছে। কি আর করা। গন্তব্যে তো পৌছাতে হবে। হাঁটা শুরু করে। সৈকত মনের আনন্দে আগে আগে পা ফেলে চলছে। হাতে ছোট একটা পুটলি। তার জন্যে একটু ভারি হলেও আনন্দে তা তার কাছে ভারি মনে হচ্ছে না। বাবা মা কোন কথা বলছে না। সারাদিনের কøান্তি আর উপোসে মনমরা। সৈকতের ছোটবোন টিনু মায়ের কোলেই। সে ঘুমে ঘুমে। চারদিক আন্ধকারহয়ে আসছে। মনে শঙ্কাও আছে। সারা রাস্তায় কোন লোকজনের দেখা নেই। হঠাৎ ওষ্ঠা খেয়ে রাস্তায় পড়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সৈকত। বাবা পেছন থেকে দৌড়ে এসে তুলে নেয়। ততক্ষণে ধুলাবালিতে চোখে মুখে একাকার। ওরা যখন দাদাবাড়ি পৌছে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। বাড়িতে কোন আলো নেই। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কারো বাড়িতে সন্ধ্যার প্রদীপ পযর্ন্ত জ্বলে না। পাশের হিন্দু বাড়িগুলোতে আগে সন্ধ্যা হতেই তুলসি তলায় ধুপবাতি জ্বলতো, কাঁসর ঘন্টাধ্বনি বেজে উঠতো। সেই বাড়িগুলো এখন ফাঁকা। সুনশান নিরবতা। সৈকতের বাবার হাকডাক শুনে ছোট ভাই ও বড় ভাইয়ের বউ ঘরের দরজা খুলে। সবাইকে দেখে তো ওরা কেমন যেন হয়ে গেলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। সৈকতের দাদি বলল তোমরা হাত মুখ ধুয়ে নাও। সৈকতের দাদাবাড়ি আসার আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেলো। মনে মনে কত কিছু করার ঠিক করেছিল। কিন্তু সবার গম্ভীর ভাব দেখে কিছুই ভালো লাগছিল না। এর মধ্যে জেঠাতো বোন কাজল এসে সৈকতের হাত ধরে বলল চলো আমরা ঘরে যাই। সৈকতের বাবাকে জানানো হলো আগের দিন রাতে এলাকার মুন্সি রাজাকার বাবা ও মেঝ ভাইকে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। সারাদিন কোন খবর পাওয়া যায়নি। সকালে একবার মিলিটারি ক্যাম্পে যেতে হবে। সারারাত কারো ঘুম হয়নি। সবাই থেমে থেমে কান্নাকাটি করছে। সৈকতের মা বলল, গ্রামেও মিলিটারি পৌছে গেছে। মানুষ তো আর বাঁচবে না। মানুষ পালিয়ে আর কোথায় যাবে। মিলিটারির চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো রাজাকার। ওরা গ্রামে কার ছেলে যুদ্ধে গেলো, কার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নেয় সব খবর মিলিটারিদের কাছে পৌছে দেয়। ওরা দেশের মানুষ হয়ে পাকিস্তানিদের দালালি করে যাচ্ছে। সৈকতের বাবা রাগে গজ গজ করতে করতে কথাগুলো বলল। ভোরের আযানের পর সৈকতের বাবা ও উনার ছোট চাচা শুক্কুর মিয়াকে নিয়ে থানা সদরের দিকে রওনা দেয়। বেলা তখন ১০টা কি ১১টা।
সৈকত জেঠাত বোন কাজলের সাথে উঠোনে পুতুল বিয়ে খেলছে। সবাই যার যার কাজে আছে ঠিক কিন্তু বার বার রাস্তার দিকে চোখ। ওরা যে মিলিটারি ক্যাম্পে গেলো, কবে ফিরতেছে। এর মধ্যে সৈকতের বাবার বাড়ি আসার খবরও পৌছে যায় রাজাকার মুন্সিমিয়ার কাছে। সে আবারও দুইজন মিলিটারি নিয়ে হাজির হয় সৈকতের দাদাবাড়ি। সবাই ভয়ে সরে পড়েছে। ওদের তর্জন গর্জনে ভিমরি খেয়ে পড়ে সৈকতরা। কি করবে ভাবতে নাভাবতে দেখলো সৈকতের ছোট খালাকে রাজাকার মুন্সি আর একজন মিলিটারি শাড়ি ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে নিয়ে আসতেছে। সৈকতের মাও আরেকজন দৌড় দিল পুকুর পাড়ের জঙ্গলের দিকে। এমন সময় কাজল কি করে সাহস পেলো কী জানি, দুইহাতে খেলার ধুলিবালিগুলো নিয়ে অচমকা ছুঁড়ে মারল দুইশত্রæুর চোখে মুখে। মিলিটারি ও রাজাকারটাও বুঝতে পারেনি এমন কান্ড ঘটতে পারে। এ সুযোগে ওদের হাত থেকে সৈকতের খালা নিজেকে ছাড়িয়ে দেয় দৌঁড়। এমন সময় সৈকত দেখল একটা কোদাল। সে কোদালটা নিয়ে গায়ের যত শক্তি আছে সব দিয়ে মারল এক কোপ মিলিটারির পায়ে। তারপর আর পেছন ফিরে তাকায়নি কাজলের হাত ধরে প্রানপনে দৌঁড় দেয় মায়ের পিছু পিছু।