‘খালের মুখ ছোট করে স্লুইচ গেট জলাবদ্ধতা তো হবেই’

42

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘কর্ণফুলী নদী রক্ষা করা না গেলে চট্টগ্রামের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে’ বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। গতকাল রবিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে এক অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন। মনজিল মোরশেদ বলেন, কর্ণফুলী নদীর পাশে একটা রাস্তা হচ্ছে। সিডিএ রাস্তাটি করছে। পাকা রাস্তা আছে সেটার পর ১২০ ফুট জায়গা রেখে নদীর পাশে রাস্তাটি করা হচ্ছে। একটি রাস্তার ১২০ ফিট পরে নদীর পারে আরেকটি রাস্তা, সেটা কেন? মাঝখানে যে ১২০ ফিট রাখা হয়েছে সেটাও তো নদীর জায়গা। এটা কার জন্য রাখা হয়েছে ?
সিডিএ হচ্ছে ডেভলপিং অথরিটি (উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। সিটি কর্পোরেশন জনগণের প্রতিনিধি, তাদের বাইপাস করে এ ধরণের উন্নয়ন পরিবেশের জন্য শুভকর নয়। কর্ণফুলী নদী রক্ষা করা না গেলে চট্টগ্রামের অস্তিত্ব দুর্বল যেমন হবে, তেমনি হুমকিতেও পড়বে। তিনি বলেন, সিডিএতে যারা চেয়ারম্যান হিসাবে আসেন, ওনাদের কাজ হচ্ছে কত বেশি টাকা আনা যায়। কোথায় কি হবে সেটা না, জনগণের জবাবদিহিতা তো নেই। জাস্ট টাকাগুলো খরচ করে কিভাবে চলে যাওয়া যায়। একটা শহরকে কতটা অকার্যকর করে দিতে পারেন সেটার উদাহরণ আর কি দেখাবো। ঢাকাও একইভাবে করা হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ছিল, কি করেছে? মনজিল মোরশেদ বলেন, পাহাড় কাটলে সেটা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাঁশখালীতে পাহাড় কেটেছে, আমরা রিট করেছিলাম। সেটাতে পাহাড় পূর্বের অবস্থায় আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এটা তো দৃষ্টান্ত হতে পারে। কর্ণফুলী নদী, পাহাড়- এগুলো তো বিচিত্রময় সৃষ্টি। এমন সৃষ্টি আরেকটা কি বাংলাদেশে দেখাতে পারবেন? এটা তো রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের।
প্রশাসন পারে না এমন কোনো কাজ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, সলিমপুরে সরকারের একটি প্রকল্প হবে। সে জন্য তোরজোড় করে উচ্ছেদ অভিযান করছে প্রশাসন। অন্য জায়গায় পাহাড়ে অভিযান হচ্ছে না। বৈষম্যহীনভাবে কাজ করতে হবে। অন্যান্য যে সমস্ত জায়গায় পাহাড় দখল আছে সেখানেও উচ্ছেদ করতে হবে। বৈষম্যহীনভাবে পাহাড় দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
চট্টগ্রামের মিডিয়া খুবই সচেতন জানিয়ে তিনি বলেন, আমার জনস্বার্থে মামলার পরে এক তৃতীয়াংশ ইটভাটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। অন্যান্য ইটভাটা এখনো পরিবর্তন করা যাচ্ছে না বা হচ্ছে না। একটি উপজেলায় সাড়ে তিনশ ইটভাটা থাকলে সেখানকার পরিবেশ কি হবে সেটা চিন্তা করেন। অনেক বাচ্চারও ফুসফুসের সমস্যা হচ্ছে।
মনজিল মোরশেদ বলেন, হালদা নদীর মতো মাছের সোর্স নিয়ে কেন আন্দোলন করতে হবে? প্রশাসন কেন সেটা রক্ষা করতে পারবে না? হাইকোর্টের নির্দেশে তো র‌্যাংগস ভবন, বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। এতো কিছুর পরও হালদাতে কারখানা বর্জ্য কেন পড়বে? একটা কারখানা থেকে পাঁচশ কোটি টাকা টেক্স আসতে পারে। কিন্তু হাজার কোটি টাকা দিয়েও কি হালদা নদী তৈরি করা যাবে? এমন একটা প্রাকৃতিক নদী কি আমরা চাইলেও করতে পারবো?
তিনি বলেন, চাক্তাই খাল সার্ভে করে আরএস দাগ অনুসারে উচ্ছেদ করতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যে এই মামলার রায় আসবে। জলাবদ্ধতা হয়, হবে না। খালগুলোর মুখ ছোট করে দিয়ে ¯øুইসগেট করে দিলেন, জলাবদ্ধতা তো হবেই। সব জায়গায় প্রমাণিত হয়েছে এটা (স্লুইসগেট) কোনো কাজের না। প্রকৃতিকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। নদীর জীবন সত্ত্বা আছে। তাকে গলা টিপে ধরলে হবে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, পরিবেশ বান্ধব নান্দনিক চট্টগ্রাম মহানগর গড়তে সব ধরণের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে আমি দ্বিধা করবো না। যে পাহাড় কাটবে তাকেই জেলে ভরতে হবে। খাল-নালা, ফুটপাত দখলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। আগামিতে নিয়মিত তা অব্যাহত থাকবে। দখলকারীরা তথাকথিত যতই প্রভাবশালী হোক আমরা তার তোয়াক্কা করিনা। আগামিতেও করবো না।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকারী প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এখন থেকে পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার সঠিক বাস্তবায়ন করা না হলে আগামি দশ বছরে চট্টগ্রাম মহানগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব নান্দনিক চট্টগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন অবশ্যম্ভাবী।
উদ্বোধনী বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মুমিনুর রহমান বলেন, পাহাড়-নদী-খাল দখলকারী মসজিদের ঈমাম বা পুরোহিত যেই হোক না কেন তাদের নীতিগত দুর্বলতা থাকবে। দূর্বত্তদের বিরুদ্ধে সঠিক আইনের প্রয়োগ করা হলে তারা পালাবেই।
তিনি বলেন, জঙ্গল সলিমপুর থেকে পাহাড়খেকোদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমাকে বদলির হুমকি দেয়া হয়েছে। আমি তাদের সাধুবাদ জানিয়ে বলেছি- আমি যেখানেই চাকরি করি আমার বেতন অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাতো কম হবে না। আমরা যারা সরকারি চাকরি করি, তারা দূর্বত্ত-খারাপ লোকদের ভয় না পেলে অনেক কাজ করতে পারবো। আমাদের পাহাড় অভিযানকে সর্বস্তরের জনগণ সমর্থন দিয়েছে। যারা পাহাড় খায়, বালি খায়, সরকারি গাছ খায় তারা কখনও ভাল মানুষ নয়। তাদের বিতাড়িত করা সহজ।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক মফিদুল আলম বলেন, জনগণ সচেতন হলে আমাদের কাজ করাটা সহজ হয়। আমাদের অনেক সীমাবন্ধতা সত্তে¡ও পাহাড়, খাল নদী রক্ষায় প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি চৌধুরী ফরিদের সভাপতিত্বে ও দিলরুবা খানমের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন চুয়েটের সাবেক ভিসি ও ওয়াসার চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম ও সিনিয়র সাংবাদিক আলীউর রহমান। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সিডিএ বোর্ড মেম্বার স্থপতি আশিক ইমরান। বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম চট্টগ্রাম চেপ্টারের সভাপতি প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাশ।