কেমন করে এমন হলাম

11

আজিজ রাহমান

স্কুল জীবন থেকে রবীন্দ্র নজরুল হওয়ার তাড়না ভেতর থেকে জেগে ওঠে। একসময় কলেজে পা বাড়াতেই এলাকার ক্লাবের সাথে জড়িয়ে যাই নিবিড়ভাবে। ক্লাবের নির্বাচনে আমার দায়িত্ব অর্পিত হয় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। সেই সময় থেকে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে বের করতাম দেয়ালিকা। কলেজের দেয়ালিকা দেখে দেখে শিখতাম কিভাবে তা বানাতে হয়। ক্লাবে দেয়ালিকায় সবার লেখার সাথে নিজের লেখাও প্রকাশ করতাম। এভাবেই সৃজনশীল লেখালেখিতে আমার প্রবেশ। ক্লাবের নানা সামাজিক কর্মকান্ডে কয়েক বছর কেটে যায়। একদিন আমার জন্মস্থান চট্টগ্রাম শহরের পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় একটি ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুর রউফ এর সাথে। পরে নাম পরিবর্তন করে হলেন রাশেদ রউফ। যিনি আজ বরেণ্য কবি ও শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। তিনি ছিলেন তখনকার তুখোড় চিঠিপত্র কলাম লেখক। আমাদের এলাকায় থাকতেন তিনি। তার সাথে এলাকায় গড়ে তুলি ‘অভিযান’ নামে একটি নতুন সাহিত্য সংগঠন। এ সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন শিশুসাহিত্যিক আবুল কালাম বেলাল, শিশুসাহিত্যিক রহমান হাবীবসহ আরো অনেকে। এখান থেকেই বের হতো বড়দের সাহিত্য উপযোগী লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রেরণা’ আর ছোটদের পত্রিকা ‘দুরন্ত’। দুটোর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন রাশেদ রউফ। সহ-সম্পাদক হিসেবে আমিও সম্পাদনার সাথে ছিলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই দুটো পত্রিকা সম্পাদনার সুবাদে আমার সাহিত্যচর্চা পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে যায়। রাশেদ রউফকে ঘিরে নিয়মিত বসতো সাহিত্য আড্ডা। এ সময় থেকে আমার ছড়া ও গদ্য কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
এরইমধ্যে ১৯৮৫ সালে আমরা ‘অভিযান’ এর লেখকগোষ্ঠী ‘স্বকাল’ শিশুসাহিত্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শিশুসাহিত্যিক রহীম শাহর আমন্ত্রণে সাড়া দিই সংগঠনের সম্ভবত তৃতীয় সাহিত্য আসরে যোগ দিয়ে। এরপর স্বকালের সাহিত্য আসরে একটানা যোগ দিয়ে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করি। আসরে উপস্থিত অগ্রজ লেখকদের চৌকস আলোচনায় নিজেকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করতে থাকি। তুলোধুনো সমালোচনা হতো এ আসরে যা সহ্য করে এগিয়ে যেতাম। তা সত্বেও শিশুসাহিত্য চর্চার উপযুক্ত মাধ্যম পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করি। সেই থেকেই শিশুসাহিত্য আমার প্রধান চর্চিত মাধ্যম হয়ে গেল। এ সময় অজস্র ছড়া লেখা হয়ে যায় আমার। দেশের নানা পত্রিকায় ছড়া ছাপা হতে থাকে। ১৯৮৫ সালে বের হয় প্রিয় কবি সুজন বড়ুয়ার ‘বাড়ির সঙ্গে আড়ি’। এটি ছিল কিশোরকবিতার নির্ভেজাল একটি বই। বইটি পড়ার সাথে সাথে কেমন করে যেন কিশোরকবিতার প্রতি অতিমাত্রায় মনোযোগী হয়ে পড়ি। এ সময় থেকে শুরু হয়ে যায় কিশোরকবিতা চর্চা। টানা কয়েক বছর কিশোরকবিতার ওপর কাজ করতে গিয়ে এর নতুন মেরুকরণ নিয়েও ভাবতে থাকি।১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর কবি রাশেদ রউফের উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম কিশোরকবিতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনও আমাকে প্রাণিত করে। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আখতার হুসেন, সুজন বড়–য়া ও রহীম শাহ সম্পাদিত “বাংলাদেশের বাছাই কিশোরকবিতা” সংকলনে আমার একটি কিশোরকবিতা স্থান পায়। এতে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ হই কিশোরকবিতায়। একটা পান্ডুলিপিও তৈরি করে ফেলি। যা বিশেষ কারণে সে সময় বই আকারে রূপ লাভ করেনি। এই ফাঁকে দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসরের সম্পাদক নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজীর অনুরোধে আমার একটি কিশোর উপন্যাস রচনায় হাত দিই। আগামীদের আসরে আমার কিশোর উপন্যাস ‘হিটলুর গোপন মিশন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হওয়ার পর ১৯৯৫ সালে বই আকারে প্রকাশ পায়। ১৯৮৬ সাল থেকে ডেইলি লাইফ, দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক ঈশান, সাপ্তাহিক চট্টলাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মজীবন শেষ করে ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে নিজেই প্রকাশ করি নান্দনিক পারিবারিক পত্রিকা ‘লাবণ্য’। গড়ে তুলি ‘আইকো’ নামের প্রকাশনা ডিজাইন হাউস। এর মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে সাহিত্য সাধনায় অনেক বছর ছেদ পড়ে। দীর্ঘ বিরতির পর কবিবন্ধু রাশেদ রউফের আন্তরিক আগ্রহে যে পাÐুলিপিটি পঁচিশ বছর আগে আলোর মুখ দেখেনি সেটি বের করার উদ্যোগ নিই। ২০১৬ সালে বের হয় আমার প্রথম কিশোরকবিতার বই ‘রাঙা আলো রঙ ছড়ালো’। এটি ‘বাংলাদেশের কিশোরকবিতা : আলোর ঝলক’ শীর্ষক সম্মেলনে সেরা গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এতে আরো বেশি প্রাণিত হলাম কিশোরকবিতায়। সেই থেকে কিশোরকবিতা চর্চায় আবারো নিবেদিত হয়ে পড়ি। এরপর শিশুসাহিত্যে কাজ করার ওপর অনেকগুলো স্বীকৃতি পাওয়ার পর এবছর পেলাম অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০২৩। পুরস্কার আনন্দের বটে। সত্যিকার অর্থে এসব স্বীকৃতি বা পুরস্কারের চেয়ে আমি বেশি প্রাণিত হই পাঠকের অপরিসীম ভালোবাসায়। এখনও এই মাধ্যমে সরব ও প্রাণবন্ত থাকতে চাই আমাকে পাঠকের ভালোবাসা তাড়িত করে বলে।