কায়সারের ফাঁসি আপিলেও বহাল

15

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া হবিগঞ্জে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের ফাঁসির রায় আপিলেও বহাল রয়েছে। এটি আপীল বিভাগের নবম রায়। মৃত্যুদন্ডের যে রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিল, সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়েও তা বহাল রেখে গতকাল মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ গতকাল মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেয়।
কায়সারের আপিল আংশিক মঞ্জুর হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি বহাল রয়েছে। আপিল বেঞ্চের অন্য তিন বিচারপতি হলেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান।
রায় ঘোষণার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ে আমাদের দেশে ধর্ষণে সহযোগিতা করার দায়ে প্রথম কোনো আসামিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। ওই অভিযোগের যে ভিকটিম, সে নিজে কোর্টে এসে সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তার মেয়েও আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছে দুর্দশার কথা। এই ১২ নম্বর অভিযোগটিতে চার বিচারপতিই একমত হয়ে মৃত্যুদন্ড বহাল রেখেছেন। আর ৫ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম শাজাহান বলেন, এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে তা দেখে আমরা রিভিউ আবেদন করবো।
সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হবে। তবে আইনজীবীরা জানান, আপিলের রায় হাতে পেলে তা রিভিউ চেয়ে আবেদন করতে পারবেন কায়সার। রিভিউ খারিজ হলে রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন তিনি। তা নাকচ হলে রায় কার্যকর হবে।
যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর আপিলে আসা এটি নবম মামলা, যার ওপর মঙ্গলবার চূড়ান্ত রায় হলো। এর আগে কায়সারের আপিল মামলা শুনানি শেষে গত ৩ ডিসেম্বর রায়ের জন্য ১৪ জানুয়ারি দিন ধার্য রেখেছিলো আদালত। আদালতে কায়সারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এস এম শাহজাহান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
মুসলিম লীগ নেতা কায়সার ছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশ্বস্ত সহযোগী। ‘কায়সার বাহিনী’ নামে দল গড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে মানবতাবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করেন তিনি। কায়সার স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের আমলে বিএনপির, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। দল বদলের কৌশলে এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রীও হন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করা হয়, কায়সার এতোটাই নগ্নভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিলেন যে নিজের গ্রামের নারীদের ভোগের জন্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। সাতটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কায়সারকে মৃত্যুদন্ড দেয়, যার মধ্যে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। এই দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে একজন এবং তার গর্ভে জন্ম নেয়া এক যুদ্ধশিশু এ মামলায় সাক্ষ্যও দেন। আর একটি ছিল নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ। এছাড়া অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যায় সংশ্লিষ্টতার চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদন্ড এবং তিনটি অভিযোগে আরও ২২ বছরের কারাদÐ দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ১৫ মে ট্রাইব্যুনাল কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। বয়স ও স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালে তাকে শর্তসাপেক্ষে জামিনও দেয়। যুদ্ধাপরাধের ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পরের বছর ২ ফেব্রূয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। সেই বিচার শেষে ২০১৪ সলের ২৩ ডিসেম্বর তার মৃত্যুদন্ডের রায় আসে। রায়ের পর এ যুদ্ধাপরাধীকে কারাগারে পাঠানো হয়। ঘোষিত আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবেন আসামিপক্ষ। ট্রাইব্যুনাল অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দন্ডাদেশ ছিল এটিই প্রথম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে ‘দমনের অস্ত্র হিসাবে’ ধর্ষণের ব্যবহার এবং সেই পাশবিকতার শিকার নারীদের দুর্দশার কথা বার বার উঠে আসে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও ওই রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়। ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং যারা ইতোমধ্যে মারা গেছেন, তাদের মরণোত্তর সম্মান জানিয়ে স্বজনদের শোক ও দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলেন ট্রাইব্যুনাল।
কায়সারের বিরুদ্ধে ৪৮৪ পৃষ্ঠার ট্রাইব্যুনালের রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫০০-৭০০ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন। তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফর্মও ছিল।