কালো মেয়ে

516

আমাদের দক্ষিণ ভিটার পেছনের দিকে একখন্ড বাগান, তাতে নানা জাতের ফুল ও ফল গাছ। এদের মধ্যে তেজপাতা, হাসনাহেনা, কামিনী ও শেফালি গাছ একেবারে গলায় গলায় ভাব করে বেড়ে উঠেছে। অন্যান্য গাছগুলি একটু দূরে। বাগানের মাঝ বরাবর ইউক্যালিপটাস। যেন অন্যান্য গাছকে পাহারা দেয়ার জন্য আকাশের দিকে হুহু করে বেড়ে গেছে। তার ডানপাশে পাশে শিমুল। এত বছর গাছটির কথা বেমালুম ভুলে ছিলাম। শহরে চলে আসার পর একবারের জন্য তাকে মনে পড়েনি। আজ বাগানে হাঁটতে যেয়ে খেয়াল হল তার কথা। জানি না, কখন ও কিভাবে শিমুলের মৃত্যু হয়েছিল। সেই শূন্যস্থানের দিকে তাকালে এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই, লাল টকটকে ফুল, যেন আগুনের রঙ নিয়ে খেলা করছে। অনেকে বলাবলি করত, কামিনী ফুলের গন্ধে নাকি সাপ আসে। এ কারণে তার ছায়া ডিঙিয়ে শেফালি ফুল কুড়াতাম। কামিনী গাছের অসংখ্য হাত পা। চিকন। মোটা। মনে হত, নজরে না রাখলে আলগোছে আমাকে গিলে খাবে কিংবা একটা সাপ ঝোপের আড়াল থেকে তেড়ে আসবে। কেমন গা ছমছম করা ভাব। একটা অস্বস্তি। সেজন্য সর্বক্ষণ এক চোখ নিবদ্ধ থাকত কামিনীর ওপর। এই ভয়ে কখনো একা একা বাগানে যাইনি। সমবয়সী কেউ না কেউ আমার সাথে থাকত। সর্বক্ষণ। প্রায় রাতে ছোট ফুফু গল্প বলতেন, আমাদের বাগানে মধ্যরাতে রাজ্যের পরী নেমে আসে। তারা গান গায়। নাচে। ভোরের দিকে ফুল নিয়ে চলে যায় নিজেদের দেশে। সম্ভবত আমার মত ওরাও মালা গাঁথতে পছন্দ করে। প্রায়দিন ঘুম থেকে উঠে ফুল বাগানে যেতাম। মনে হত, বিকেলে যতগুলো ফুল দেখেছি সকালবেলা ঠিক ততগুলো নেই। কিছুটা কম। তখন পরীদের ওপর রাগ হত। একবার আমরা ছোটরা মিলে পরিকল্পনা করলাম, বিকেলবেলা ফুলগাছের ওপর মাছ ধরা জাল বিছিয়ে রাখব। একটা পরী ধরতে পারলে সারাজীবন রাণীর মত নিশ্চিন্ত জীবন যাপন। শুনেছি, পরীদের অনেক ক্ষমতা। তারা মানুষের যেকোন ইচ্ছে পূরণ করার ক্ষমতা রাখে। যাদের এত ক্ষমতা তাদের অনুরোধ করলে নিশ্চয় আমার গায়ের রঙ ফর্সা করে দেবে। কালো বর্ণের কারণে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। সেসব কণ্টকের মত বিঁধত। শুধু ফর্সা হওয়ার জন্যই যে পরী ধরতে চাইতাম তা নয়। ওদের ডানা থেকে পালক সংগ্রহ করার ইচ্ছেও ছিল। অনেকদিন থেকে পালক দিয়ে হাতপাখা বানাবার পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছিল। আমরা অনেক ভাবলাম। কিন্তু কোনমতেই একটা জালের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। জালের অভাবে আমাদের পরী দেখা হয়নি। আর সে কারণেই আমি কালো। শুনেছি, পরীরা নাকি খুব ফর্সা ধবধবে হয়। তখন বুঝিনি, এটা বর্ণ বৈষম্য। যা ব্রিটিশদের কাছ থেকে আমার পূর্ব পুরুষ ধারণ করেছেন। সেখান থেকে আমি। মনে প্রাণে ভাবতাম, যদি পরীর মত সুন্দর হতে পারতাম তাহলে নিশ্চয় বড়দির মত আমাকেও সবাই ভালোবাসত। আমার দাদি ছিলেন ভীষণ রকমের ফর্সা। সুন্দরী। এই জন্যই নাকি দাদা তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। যখনকার কথা বলছি তখন তিনি বেশ বয়স্ক। লোলচর্ম। তবে সাবলীলভাবেই হাঁটতে পারতেন। মাঝে মাঝে রান্নাও করতেন। তাঁর শরীর মোমের মত মসৃণ, নরম, তুলতুলে। ধরতে বেশ লাগত। কিন্তু দাদি সেটা পছন্দ করতেন না। হাসতে হাসতে বলতেন, মাগি বুড়ি হইলে তোর শরীরও অমন হইবো। দাদির সাথে আমার সম্পর্ক ছিল মধুর। হাসি ঠাট্টার। আমার পক্ষ থেকেই সেটা গড়ে উঠেছিল। এই গাঢ় সম্পর্কের মূল কারণ, একটি কাঠের সিন্দুক। তিনি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেই সিন্দুকের ভেতর রাখতেন। রাখার পর পর তালা বন্ধ। চাবি তাঁর আঁচলে বাঁধা। কত শতবার চাবি চুরি করার পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি সতর্ক থাকতেন। আমি অসংখ্যবার উঁকি দিয়ে দেখতে চেয়েছি, সিন্দুকে কী আছে। কিন্তু প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সে কারণে দাদির সাথে আমার সম্পর্ক অন্যান্য নাতিদের মত অগভীর নয়। আমি তাঁকে দুনিয়ার প্রশ্ন করতাম। যার বেশিরভাগ ছিল অর্থহীন। দাদির পাশে ঘুমানো নিয়ে ছোটদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত। তিনি সারারাত তালপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। সে কারণে গরম অনুভূত হত না। প্রায় রাতে আমি আগে আগে শুয়ে পড়তাম, তাঁর নির্ধারিত স্থানের বাম পাশে। এমন সুযোগ যে প্রতিদিন হত তা নয়। মাঝেমাঝে অন্য কেউ শুয়ে পড়ত। তিনি ঘুমের মধ্যেও কী করে তালপাখা নাড়তেন সেটা একটা রহস্য। দাদির মুখে অনেক সুখ-দুঃখের গল্প শুনেছি। তাঁর বিয়ে হয়েছিল একেবারে ছোটবেলায়। কোলে কোলে। বিয়ের অনেক বছর পর তাঁর প্রথম মাসিক হয়েছিল। সেই বিশেষ দিনগুলোতে মেয়েদের স্বামীর ঘরে থাকতে দেয়া হত না। তখন তিনি রান্নাঘরে থাকতেন। দাদির শাশুড়ি ছিলেন খুব কড়া। খাওয়ার সময় পিঁড়িতে বসতে দিতেন না। পিঁড়িতে বসলে পেট ভরে খেয়ে ফেলবেন আর তাতে কাজের সমস্যা হবে এজন্য বাড়তি সতর্কতা। এমনকি ভাতের সাথে লবণও দেয়া হত না। বিয়ের পর পর তিনি তাঁর সখের নাকফুল হারিয়ে ফেলেছিলেন। সে নিয়ে তাঁর মনে বিপুল আক্ষেপ টের পেয়েছি। আমার দাদি একেবারে বকলম মানুষ ছিলেন না। তিনি নাম লিখতে পারতেন। তখনকার দিনে কলাপাতায় লেখার চল ছিল। একবার তিনি নিজের নাম কাগজে লিখে আমাকে দেখিয়েছিলেন। বড্ড এবড়ো-থেবড়ো। দ্বিতীয় শ্রেণির বাচ্চার মত লাইনচ্যুত। নাম লেখার পর এক ধরনের আত্মতৃপ্তি দেখেছি তাঁর চোখে। একবার তিনি বললেন, যারা সুন্দরী তারা নাকি মৃত্যুর পর গাছ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে।
– কী গাছ দাদী?
-হাসনাহেনা, শেফালি, কামিনী…
এরপর আমার মাথায় দুনিয়ার চিন্তা-দুঃশ্চিন্তা। অন্যান্য বোনের মত আমি উজ্জ্বল বর্ণের নই। অনেকটা চাপার দিকে। তাই সারাক্ষণ ভাবতাম, কী করে ফর্সা হওয়া যায়। মৃত্যুর পরে সুগন্ধি গাছের রূপ ধরে ফিরে আসার দুর্ধর্ষ এক জেদ চেপে ধরে। আমার বোনদের কী আনন্দ! তারা মৃত্যুর পর আবার ফিরে আসতে পারবে। তাও সুগন্ধি গাছ হয়ে। শুধুমাত্র রঙের কারণে মৃত্যুপুরিতে কেঁদেকেটে মরব আমি। এটা মেনে নেয়া আমার পক্ষে কষ্টকর। অনেকে বলত, কাঁচাহলুদ মাখলে নাকি রঙ ফর্সা হয়। সে অভিপ্রায়ে প্রায় হলুদ মাখতাম। উত্তর ভিটায় ছিল বড় দাদির মাটির ঘর। ছোট দাদিকে নিয়ে দাদা দক্ষিণ ঘরে থাকতেন। পরে কোন একসময় তারা পুবের ভিটায় উঠে গিয়েছেন। বড় দাদির ঘরের দেয়ালে একটি আয়না মাটির সাথে আটকানো। হলুদ মাখার পর সেই আয়নাতে নিজের মুখ দেখে প্রশ্ন জাগত, একটু কি ফর্সা লাগছে? সমাজের মত আয়নাও বোধহয় রঙ চেনে। তাই আমার কথার জবাব দিত না। বড়দি বলতেন, তার সাথে আয়না নাকি রাজ্যের কথা বলে। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে এক কালো মেয়ে বেড়াতে আসত। ওদের পাড়ার কেউ ওর সাথে খেলত বলে, বাঁধ পার হয়ে হানা দিত এ পাড়ায়। আমি খেলতাম। কালো বলে ছোটবেলা থেকেই আমার মনে কোন অহংকার ছিল না। প্রতি বিকেলে মনে মনে মর্জিনাকে খুঁজতাম। কিন্তু দু’দিন ধরে মেয়েটার খবর নেই। ও কাছাকাছি থাকলে নিজেকে বিশেষ কেউ মনে হত। আরও অনেকদিন গত হল। মর্জিনা লাপাত্তা। কয়েকদিন বাদে রাবেয়া ফুফু জানালেন, মর্জিনার বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের কথা শুনে আমি অবাক। অতটুকু মেয়ের বিয়ে? ফুফু আমার প্রশ্ন কানে নিলেন না অথবা শুনলেন না। তিনি বলে চলছেন, ও পাড়ায় গিয়েছিলাম মর্জিনার জামাইকে দেখতে। বলতে বলতে তাঁর মুখে এক ধরনের কুটিল হাসি। সেটা দেখার ভুলও হতে পারে। তিনি না থেমে বলে চলছেন, জামাইয়ের অনেক বয়স। আগেও নাকি একটা বিয়ে হয়েছে। সে ঘরে মর্জিনার চেয়ে বড় বড় মেয়েও আছে। ফুফুর কথা শুনে আমি ভয় পেলাম। আমার সহমর্মিতা যতখানি না মর্জিনার জন্য, তার চেয়ে বেশি নিজের জন্য। তাকে ভয়ের কথা বলতে পারছি না। এ কথাগুলো কোনদিন কাউকেই বলতে পারিনি। কেন পারিনি, তা আল্লাহই জানেন। আমাদের পরিবারের মধ্যে আমিই যা একটু কালো। রাবেয়া ফুফুও বেশিরভাগের দলে। ফুফুর চোখের দিকে চেয়ে আমি এক চিলতে আশ্রয় চাইলাম…

-ওর বাবা ওখানে বিয়ে দিল কেন?
-মর্জিনার যে বিয়ে হয়েছে তাই তো সাত কপালের ভাগ্য। যে কালো মেয়ে…