কারেন্ট জালে আটকা পড়ে মরছে ডলফিন

47

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডলফিন নিয়ে হালদা গবেষক ড. সফিকুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ডলফিন পানিতে বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী কিন্তু এরা মাছ নয়। মানুষের মতোই ডলফিন ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, বাচ্চা জন্ম দেয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাচ্চা দুধ পান করায়। বাংলাদেশে সাত প্রজাতির ডলফিন পাওয়া যায় । যার মধ্যে গাঙ্গেয় ডলফিন মিঠাপানির নদীর প্রধান ডলফিন। যা স্থানীয়ভাবে শিশু, শুশ, হুস, হুচ্চুম, শুশুক ও ডলফিন নামে পরিচিত। এটি বর্তমানে দেশের একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। পদ্মা- ব্রহ্মপুত্র- মেঘনা এবং সাঙ্গু- কর্ণফুলী-হালদা ও অন্যান্য কিছু নদীতে পাওয়া যায়। এই ডলফিনকে প্রতি ৩০ থেকে ১২০ সেকেন্ডের মধ্যে একবার শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির উপরে উঠে আসতে হয়। ডলফিন চোখে না দেখার কারণে প্রতিধ্বনি তৈরীর মাধ্যমে চলাচল করে। ডলফিন চলাচলের সময় জালের অবস্থান প্রতিধ্বনির মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারে না (জালের সুতা শব্দ তরঙ্গ শোষণ করে)। যার কারণে সহজে জালে জড়িয়ে পড়ে।
হালদার পানি দূষণ নিয়ে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনকারী ড. সফিকুল আরও বলেন, স¤প্রতি আমি হালদা নদীর পাঁচটি পয়েন্ট (নাজিরহাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত) থেকে পানি সংগ্রহ করে নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে ১১টি প্যারামিটারে পানির গুণগতমান আদর্শ মানের মধ্যে পেয়েছি যা মাছ, ডলফিন এবং অন্যান্য জলজপ্রাণি বসবাসের উপযোগী। এছাড়া হালদা নদী থেকে সর্বশেষ প্রাপ্ত মৃত ডলফিনের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। হালদা নদীতে ডলফিন মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত জাল বিশেষ করে কারেন্ট জালে আটকা পড়ে ডলফিন এর মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য কিছু কারণ সম্পৃক্ত।
হালদা নদীকে গাঙ্গেয় ডলফিনের বসবাস উপযোগী করতে হলে ১৩টি সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেন এ হালদা গবেষক। সুপারিশগুলো হল: নদীতে অবৈধভাবে যেকোনো ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে, হালদা নদী ও এর শাখা খালসমূহকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে, নিয়মিত হালদা ও শাখা খালের পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, নদীতে অতিরিক্ত ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল বন্ধ, কমিউনিটি বেইজড ডলফিন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে যেখানে বনবিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা, ডলফিন এর পরিবেশগত গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে স্থানীয় জেলে ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, নদীতে যে কোনো প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলা বন্ধ করতে হবে, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, ডলফিন শুমারি করে ডলফিন ডাটাবেজ তৈরি, হালদা ও শাখা খালে বিষ দিয়ে মাছ মারা বন্ধ করতে হবে, কৃষি জমিতে অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিরুৎসাহিত এবং জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ -(ডলফিন ও তিমি আইন) -৩৭ তম ধারা সঠিকভাবে প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ এবং ডলফিন সংরক্ষণে আলাদা বিশেষজ্ঞ মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থাকে ডলফিন সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘আঘাতজনিত, জেলেদের জালে আটকা পড়ে এবং কুসংস্কারের কারণে ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে। মৃত ডলফিন পাওয়ার পর আমরা ময়নাতদন্ত করে এসব কারণই পেয়েছি। ডলফিন বাঁচাতে হলে নির্দিষ্ট এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে হবে। নদীতে যত্রতত্র জাল ফেলা বন্ধ করতে হবে। ডলফিনের মৃত্যুর কারণগুলো চিহ্নিত করা গেলেও কক্সবাজার সৈকতে তিমি মৃত্যুর কারণগুলো এখনো চিহ্নিত হয়নি। তবে জেলেদের জালগুলো এতো বেশি ঘনঘন বসানো হয় যে প্রায় সময় জালেই আটকা পড়ে এসব প্রাণির মৃত্যু হয়। জেলেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে।’