কাঁঠালের আমসত্ব, সিসি ক্যামেরার বিশেষত্ব, বাদী বিহীন মামলা তত্ত্ব

22

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

কাঁঠালের আমসত্ব একটি বাংলা বাগধারা, প্রাচীন একটি কথা, বহুল আলোচিত। অর্থ অতি সোজাÑঅসম্ভব জিনিস তথা কাজের স্থানে অকাজের বস্তু। আরো সুন্দর করে বল্লে হয়, যোগ্য জায়গায় ভোগ্য লোক। ভোগ্য পণ্য আছে না, তেমনি ভোগ্য লোক। ওমাÑলোক কি কভু ভোগকরা যায়? লোক ভোগ করা যায় না, কিন্তু তার কাজ তো যায়। অর্থাৎ অর্থ দিয়ে তার থেকে স্বার্থ সিদ্ধি করা, মানে সে ঘুষখোর আরকি, হিহিহিহি। নিশ্চয় এইবার বিষয় ক্লিয়ার। আসলে কাঁঠাল এক অদ্ভুত জিনিস, নানা জায়গায় তার ব্যবহার। আহ্Ñকি সুন্দর গান, ‘ওরে পীরিতি কাঁঠালের আঠা গো, পীরিতি কাঁঠালের আঠা, সেই আঠা লাগলে যে আর ছাড়েনা। গোলেমালে গোলেমালে পীরিত কইর না।’ আহা, কাঁঠালের একি শানÑগানে কাঁঠাল, শানে কাঁঠাল, খানেও কাঁঠাল। আরো আছে, বার্গারে কাঁঠাল, কাবাবে কাঁঠাল, শাবাবে কাঁঠাল। মাশাল্লাহ্ কাঁঠালের দারুণ হালচাল। এখন থেকে কাঁঠাল খাবো মোরা সকাল-বিকাল, চিরকাল। আচ্ছা ইংরেজিতে কাঁঠালকে জ্যাকফ্রুট বলে কেন? জ্যাক মানে তো গাধা, তাহলে জ্যাকফ্রুট মানে হল গাধাফল। ওমাÑএকি কথা, কাঁঠালের এত বল, বিলেত গেলে গাধাফল। এই কথা শুনে মোর চোখে এলো জল। কাঁঠালকে নিয়ে চলবে না কোন ছল, কাঁঠালের পক্ষে আমরা সকল দল।
সম্প্রতি বারমাসি কাঁঠালের জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে, ফলে কাঁঠালের নানামুখি সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। বেরিয়ে আসতে লাগল কাঁঠালের বার্গার কাঁঠালের কাবাব সহ বহুবিধ পুষ্টিসমৃদ্ধ কাঁঠালের মুখরোচক নানাবিধ উপাদেয় সব রেসিপি। সে সাথে আরো জানা গেল কাঁঠাল মাংসের চাইতেও অধিক পুষ্টি গুণ সমৃদ্ধ মাশাল্লাহ্। তার আগে কয়েক বছর হয়ে গেল আমাদের পাটের জীবনরহস্য উন্মোচিত হয়েছে। তখন বেশ ফলাও করে প্রচার শুনতে পেলাম এবার পাট তার সোনালী ঐতিহ্য পুনরায় ফিরে পাবে। তার কিছুকাল পর আমাদের দেশে মহিষের জীবনরহস্য উন্মোচিত হল। আলহামদুলিল্লাহ্ মহিষের দই এখন হতে বিশ টাকা দরে খেতে পারবÑমনে মনে ভীষণ খুশি হলাম ভেবে। কারণ তখন তার দাম ছিল দুইশ টাকা কেজি, আর মুই কিঞ্চিৎ দই-পাগলা, হাহাহা। ওমাÑকিছুদিন যেতেই দই তিনশ টাকা দাম হয়ে গেল কেজি। ভাবলাম বাত্তি নিব্বার আগে জ¦লে বেশি, অভাব ঘুচবার আগে দলে বেশি। দইও তেমনই কিছু ক্রিয়া-কলাপ প্রদর্শন করছে কষি। অর্থাৎ সামনে মহিষের স্বর্ণালী ঐতিহ্য, হবে দইয়ের প্রাচুর্য, থাকবে না কোন আর হীনদৈন্য। আলো ফুটার আগে অন্ধকার গাঢ় হয়, তেমন দইয়ের ঢেউ উঠার আগে অভাবটা থোড়া করছে ঘেউ ঘেউ, তাই দামটা বেড়েছে, অচিরেই তা দূরীভূত হবে।
বিধি বাম, দইয়ের এখন সাড়ে তিনশ টাকা দাম। মিটে গেল সকল আশা, ভুলে গেলাম জীবনরহস্য উন্মোচনের ভাষা। তাই কাঁঠালের জীবনের কথা শুনে পাই না আর কোন ভরসা। আশা ছিল ভালোবাসা ছিল, আজ আশা নাই ভালোবাসা নাই। হলাম নিরাশা চারিদিকে হতাশা, মিটে না আর পিপাসা তার সাথে আবার নাকি দুর্ভিক্ষ করছে অপেক্ষা দেখাতে তামাশা। কাজেই চোখে দেখছি আঁধার কারণ সাথে শুরু হয়েছে দেশে রাজনৈতিক ডামাডোল। একদিকে দুর্ভিক্ষের হাতছানি অন্যদিকে রাজনীতির ফরফরানি, বিএনপির নাকি সাত এমপি পদত্যাগ করেছে। হেহেহেহে, হাসির কথা, কি’বা এসে যায় তাতে, সাতে পড়বে না কপালে হাত। ভাতে ভরা থাকবে সকলের পাত। ফলে সরকার ঘোষণা করে দিল সেই সকল শূন্য আসনে উপনির্বাচন। বাঘের বাচ্চা কাজটা করে ফেলল ভারি আচ্ছা। নির্বাচন কমিশনও ভারি বুদ্ধিমান, জারি করেদিল ভোটকেন্দ্রে এবার সিসি ক্যামেরা থাকবে না, কারণ বাজেট সঙ্কট। তবে খটকা লাগল একই সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৬৫ কিমি জুড়ে সিসি ক্যামেরা বসানোর ঘোষণা শুনে।
সিসি ক্যামেরাও বহু তেলেসমাতি জানে। মূলত তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাটাই হল আসল। কোথায় সে বসবে, কোথায় বসবে না। রাস্তায় বসবে ভোটকেন্দ্রে বসবে না, কারণ গাইবান্ধায় একবার বসে সে অনেক অপমানিত হয়েছে। সকলে সে কি ইন্সাল্ট তাকে। লজ্জা থাকলে সে আর কখনো ভোটকেন্দ্রে বসবেনা। সিসিক্যামেরা হয়েছে বলে কি তার মান-সম্মান নাই নাকি? রাজনীতিবিদরাও যেন কেমন, ইসিকে তো বিশ^াস করেনা, সিসিকেও বিশ^াস করে না। গাইবান্ধার কর্মকাÐ সিসি ক্যামেরা নিজ চোখে দেখেছে, তবুও কেউ তার দেখাকে মূল্যায়ন করছেনা। যেভাবে আব্দুল মান্নান শেখের ‘আমি দেখি নাই’ কথাকে এসআই আলাউদ্দিন মূল্যায়ন করছেন না। মান্নান শেখ গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপ জেলার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী। সেই কার্যালয় ভাঙচুরের মামলায় মান্নানকে বাদী করে বিএনপির নেতাদেরকে আসামি করা হয়েছে। মামলার আইও হলেন এসআই আলাউদ্দিন। কিন্তু মান্নান বলছেন, তিনি ঘটনা ও মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
মান্নান শেখের বক্তব্য হল, ‘কসম, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখানে আলাউদ্দিন এসআই ছিল। ওই স্যার আমারে বারবার ফোনদিয়া অস্থির কইরা ফেলছে। আমি বলছি, স্যার, আমি দাওয়াতে আছি। আমি দাওয়াতে থাইক্যা মামলা করলাম কেমনে? আমি ছিলামও না, দেখিও নাই। স্যারেগো আমি কই ছিলাম, স্যার, আমারে আপনারা ঝামেলায় ফালাইয়েন না।’ হাহাহা, সাক্ষাৎকারটি মান্নান জাতীয় এক দৈনিকে দিয়েছিলেন। এটা কোনকথা, মামলা করতে বাদী লাগবে কেন? ডিজিটাল যুগ, এখন হজে¦ থেকেও পাথর মারাযায় বাংলাদেশে। কবর হতে মুর্দা আসি গাড়ি ভাংতে পারে। অতএব দাওয়াতে থেকে বাদী হতে পারবে নাÑএমন কি কভু হতে পারে? অনেক আগের এক কৌতুক, ‘মালিক চাকরকে বললেন, মানুষের অসাধ্য কিছু নাই। চাকর প্রতিবাদ করে বলল, কে বলেছে মানুষের অসাধ্য কিছু নাই? দেখি মোমবাতি দিয়ে টেলিভিশন চালাতে বলেন তো। পানি দিয়ে আগুন জ¦ালাতে বলেন তো।’ চাকরের বক্তব্য শুনে মালিক তখন চুপসে গেলেন। কিন্তু আজ সব অবলীলায় সম্ভব। সোলার প্যানেল দিয়ে মোমবাতির আলোতে টিভি চালানো যাবে, পানি ভেঙ্গে আগুন জ¦ালানো এখন অতি সহজ একটা কাজ। তবে খরচ কিছু বেশি পড়বেÑএই যা।
সমস্যা কি, খরচ পড়লে পড়বে। জান-মান যেখানে মাইনকার চিপায়, সেখানে খরচ বহু বেশী করতে দোষ কি? ডিজিটাল যুগ বলে আজ খরচ করলে সব পাওয়া যায়। স¤্রাট আকবর তো খরচ করেও টেলিভিশন দেখতে পারেননি। দ্যা গ্রেট আলেকজেÐার গোটা রাজত্ব দিয়েও সামান্য ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা পেলেন না। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হল। কিন্তু আজ দেখুন, মাত্র ৫০ টাকার অষুধে দৌড়ে পালায় ম্যালেরিয়া, হাহাহাহা। বর্তমানের একজন শ্রমিক যে সুবিধা ভোগ করতে পারে, দুইশ বছর আগে একজন স¤্রাটও তা পারেন নি। অতএব দাওয়াতে বসে মামলার বাদী হওয়া কোন বিষয়ই না বর্তমান যুগে। আসলে বর্তমান যুগটাই আজব, এই যুগে কোথায় কি হয়, কখন কি ঘটে বলা মুষ্কিল। কখনো দেখাযায় মৃত্যুদÐ প্রাপ্ত আসামি পুলিশের চোখে স্প্রে করে পালিয়ে যায়। আবার কখনো দেখা যায় বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিকে, প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার পরেও ডাÐাবেড়ি পরে মৃত মা’র জানাজা পড়তে হয়! কাজেই আমাদের মামলাও আজব, বাদীও আজব এবং আসামিও আজব। আজব দেশের আজব কারবার তাই এখানে ডাঙ্গায় চরে রুই-কাতলা, জলের মাঝে চিল। দিন-দুপুরে চোর-চোট্টা করে কিলবিল। সেজন্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে সিসিক্যামেরা বসানোর উদ্যোগটা প্রশংসা পাওয়ার দাবী রাখে নিঃসন্দেহে। তবে সিসি ক্যামেরাকে বিশ^াস করলেই হলো, গাইবান্ধা কাÐ হলে টাকা সব জলে যাবে, হেহেহে।
এবার একটি কথা বলি, মান্নান শেখের বক্তব্য শুনে কালিদাস পÐিতের একটি বিখ্যাত ধাঁধা মনে পড়ে গেল। ‘জন্মদাতা জন্ম দিল না জন্ম দিল পরে, যখন ছেলের জন্ম হইল মা ছিল না ঘরে।’ মান্নানের ঘটনার সাথে বরাবর মিলে গেছেÑবাদী ছিল দাওয়াতে মামলা হইল থানাতে। কালিদাসের ধাঁধার উত্তরটি এখন সবাই বলছে ‘কোকিল।’ কিন্তু কালিদাস নিজে ধাঁধাটির জবাব দিয়েছেন, ‘লব-কুশ।’ লব-কুশ ছিলেন রামের পতœী সীতার পুত্র, বনবাসে বাল্মীকির গৃহে তাঁদের জন্ম ও বেড়ে উঠা। সেই দৃষ্টিতে কালিদাসের উত্তর ঠিক আছে, কিন্তু তিনি কোকিল বললেন না কেন? হতেপারে কোকিল যে কাকেরবাসায় ডিমপাড়ে এই তত্ত¡ তাঁর সময় আবিষ্কার হয়নি। কারণ তিনি ছিলেন গুপ্তযুগের প্রথম দিক্কার কবি, গুপ্তরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত’র সময়ের। আজ থেকে ষোলশত বছর আগের কথা, স্বাভাবিক বিষয় তখন এতথ্য মানুষের জানার কথা না। তবে সেই যুগটা ভারতের স্বর্ণযুগ ছিল। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে ইতিহাসে বিক্রমাদিত্য বলেও ডাকা হয়। সে সময় ভারত শিল্প-সাহিত্যে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছিল। কালিদাস ছিলেন তাঁর সভাকবি, সাথে বিক্রমাদিত্যকে অনেকে শকারিও সম্বোধন করেন কারণ তিনি শকদের দমন করেছিলেন। এবং বলা হয়ে থাকে তাঁর সময়েই শকাব্দের প্রচলন হয়েছিলো। অবশ্য কেউ কেউ এটিকে অসমর্থন করেন। তাঁদের মতে প্রখ্যাত কণিষ্কই ছিলেন প্রকৃত শকারি। আবার কেউ কেউ বলেন উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যই শকাব্দের প্রচলন করেছিলেন। তাঁর সময়কাল ছিলো ১০৫ হতে ১৫ খৃষ্টপূর্বাব্দ, ফলে কেউ কেউ তাঁকেই সঠিক মনে করছেন।
তবে অবাককরা তথ্য হল কালিদাসের ধাঁধাটির আরো একটি অংশ আছে। ‘পিতা হইল ভগ্নিপতি, ভগ্নি হইল মা, এমন আজগুবি কথা কভু শুনি না।’ আমরা জানি, কুশ ও লব বোনের কাছে মানুষ হয়েছেন। তাই তাঁরা বোনকে মা ও ভগ্নিপতিকে পিতা ডাকতেন। কোকিল যে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে- এই কথা নিশ্চয় তখন জানা ছিল। হতে পারে কালিদাস তাই তাঁর ধাঁধার সাথে দ্বিতীয় অংশটি জুড়ে দিয়েছিলেন। ভারত জ্ঞান-বিজ্ঞানে সেসময়ও অগ্রগামী ছিল, সাথে শালীনও। কিন্তু এখনÑ? কুশ-লব থেকে এসেছে বাংলাশব্দ কুশীলব, তাঁরা ছিলেন সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। কাঁঠালের একটি চুটকি বলে লিখার ইতি টানি। বিদেশি এক রাজা বাংলাদেশ জয় করলেন। তিনি শুনেছেন এখানে ভাল ফল পাওয়া যায়, তাই ঘোষণা করা হল রাজার জন্য ফল আনার। একজন আনলেন বরই। রাজা তা মুখে দিয়ে ওয়াক করে ফেলে দিলেন কারণ চুকা ছিল বিধায় বরই তাঁর ভাল লাগেনি। রাজা নির্দেশ দিলেন বরইগুলা বরইওয়ালার পুটকিতে ঢুকিয়ে দিতে। সৈন্যরা নির্দেশ পালনকালে বরইওয়ালা হাসতে থাকে। হাসার হেতু জানতে চাইলে সে জানায়, পরেরজন কতবেল নিয়ে এসেছে। কতবেলও রাজার পছন্দ হল না, ফলে একই কাÐ। কতবেল ওয়ালা হেসে জানালপরেরজন নারকেল এনেছে। নারকেলও রাজার পছন্দ হয়নি। শেষে তার হাসি দেখে সিপাহীরা জানতে চাইল পরেরজন কি এনেছে? সে হাসতে হাসতে বলল, ‘কাঁঠাল!’ তারপর চারদিকে গুঞ্জন শুরু হল, কাঁঠাল কে এনেছে, রাজার কি কাঁঠাল পছন্দ হয়েছে, হেহেহেহে?
লেখক : কলামিস্ট