কলকাতার মুসলিমদের ব্যতিক্রমী ইফতার

30

মনিরুল ইসলাম মুন্না, কলকাতা থেকে ফিরে

পবিত্র রমজান মাস এলেই কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ ও পূর্ব থেকে পশ্চিম জুড়ে দেখা যায় ইফতারের জমজমাট বাজার। তবে আমাদের দেশের খাবারের তুলনায় সেখানে রয়েছে ব্যতিক্রম। ছোলা, মুড়ি, বেগুনি থাকলেও সেখানের স্বাদ অন্য রকম। গত শুক্র ও শনিবার কলকাতা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
ঐতিহ্যবাহী নিউ মার্কেট চত্বরের মার্কুইস স্ট্রিট, কলিন স্ট্রিট, জাকারিয়া স্ট্রিট, সদর স্ট্রিটসহ কয়েকটি সড়কে স্থায়ী দোকানের পাশাপাশি অস্থায়ী দোকানে বেলা বাড়লেই জমে ওঠে ইফতার বাজার। স্থানীয় রোজাদারদের সঙ্গে এসব বাজারে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি পর্যটকরাও।
দেখা গেছে, কাটা ফল, বিরিয়ানি, হালিম, পিঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনী, নানা ধরনের শুকনা ফলসহ জিলাপি, সিঙ্গারা, চিকেন ও মাটন কষা, বিশেষভাবে তৈরি নান রুটি, বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস ছাড়াও ছোলার মতো বিভিন্ন রকমের খাবার বেশ সস্তা দামেই বিক্রি হতে দেখা যায়। ফলে এসব চত্বরে দেশ-বিদেশের পর্যটক ছাড়াও, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও খাবার কিনতে দেখা যায়। এসব বাজারে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ইফতারের আয়োজন থাকে। আর স্বাদের দিক দিয়ে দোকানগুলো কলকাতার নামিদামি রেস্তোরার ইফতারের সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারে।
ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে পর্যটকরা এরই মধ্যে কলকাতার নিউমার্কেট থেকে শপিং সেরে দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। এখানে অনেকেই চিকিৎসার জন্য, কেউ বা আবার ব্যক্তিগত কাজে কলকাতায় এসেছেন বলে জানান। তারাও রোজা রেখেছেন বিধায় এসব এলাকা থেকে ইফতার কিনে হোটেলে নিয়ে যান।
চট্টগ্রাম থেকে মো. তারেকুল ইসলাম ঈদের শপিং এবং ঘোরাঘুরি করতে কলকাতার নিউ মার্কেটে আসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তুলনায় ইফতারি আইটেম, খাবারের কিছু আইটেমের দাম একটু কম। তবে অন্যান্য জিনিসের দাম প্রায় সমান। নিউমার্কেট চত্বর থেকে ফল, পিঁয়াজু, ছোলা, হালিম, ফলের জুস ও নান রুটি নিলাম। হোটেলে গিয়ে সবাই মিলে ইফতার করবো। এর আগে শ্রী লেদার থেকে নিজের এবং পরিবারের জন্য কিছু জুতা কিনেছি।
কলিন স্ট্রিটে অস্থায়ী সেমাই বিক্রেতা সুমন বর্মন বলেন, সেমাই বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২২০ রুপি। সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তাই সেমাইয়ের দামও একটু বেশি। বাংলাদেশি পর্যটকরা আমাদের কাছ থেকে সেমাই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ওপারের ক্রেতাদের উপর আমরা অনেকটাই নির্ভরশীল।
নিউমার্কেট চত্বর ছাড়াও কলকাতার পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার, মেটিয়াবুরুজের বিভিন্ন রাস্তায় রমজান উপলক্ষে সাজানো খাবারের পসরা বসেছে। দুপুর থেকে শুরু হয় কেনাবেচা। ইফতারের সময় যত ঘনিয়ে আসে, বিক্রেতাদের ব্যস্ততা, হাকডাক ততই বাড়তে থাকে।
কলকাতার স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও বিদেশি পর্যটকদের কাছেও অন্যতম পছন্দের গন্তব্যস্থল নাখোদা মসজিদ ও জাকিরিয়া স্ট্রিট। ইফতারের আগে জাকিরিয়া স্ট্রিটের দু’ধারে সাজানো সারি সারি খাবারের দোকানগুলোতে ভিড় জমতে শুরু করে।
সে সময়টাই এখানে পা ফেলার জো থাকে না। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই এখানকার রকমারি তেলে ভাজা বিভিন্ন খাবার, হালিম, কাবাবের স্বাদ নিতে দোকানে দোকানে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে।
নাখোদা মসজিদসহ আশে-পাশে তৈরি হওয়া অস্থায়ী কাঠামোর স্থলে কাঠ কয়লার আঁচে তৈরি হচ্ছে রেশমি কাবাব, টিক্কা কাবাব, মাটন কাবাব, ফিস কাবাব, মালাই কাবাব। এছাড়াও খুব অল্প খরচে পাওয়া যাচ্ছে, চিকেন ও মাটন হালিম, বিফ হালিম, মাটন, চিকেন, বিফ বিরিয়ানি, নাল্লি নিহারী, ফিরনি। মিলছে রকমারি ফল, দেশ-বিদেশের খেজুর। অনেকের পছন্দের মোগলাই পরোটা, রুমালী রুটি, বাটার নান, কুলচা ইত্যাদি।
রকমারি সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে মাতোয়ারা পুরো এলাকা। মসজিদের সামনে থেকে একটু এগোলেই ঠান্ডা ফালুদা, লাচ্ছি, রুহ আবজাসহ বিভিন্ন ধরনের শরবতের দোকান। সারা বছরই এখানে দোকানে সুস্বাদু খাবার বিক্রি হয়। তবে এই পবিত্র মাসে এখানে উপচে পড়া ভিড় হয়।
রমজান মাস উপলক্ষে রাতের বেলা নাখোদা মসজিদ থেকে শুরু করে গোটা এলাকা সাজানো হয় রং বেরঙের নিয়ন আলো দিয়ে। ফলে একদম উৎসবের আমেজ থাকে গোটা চত্বরেই।
জাকারিয়া স্ট্রিটের অস্থায়ী হোটেল মালিক শাহ নেওয়াজ বলেন, এখানে বিক্রি ভালোই হচ্ছে। আর কয়েকদিন কাটলে এই ভিড় আরও বাড়বে। সব ধরনের খাবারের চাহিদা আছে। তবে মাটন কাবাবের চাহিদা একটু বেশি। এখানে মোগলাই খাবারের পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে, ছোলা, মুড়ি, চপ। একসঙ্গে সব কিছু মিলিয়ে ঠোঙায় ভরে নিয়ে যাচ্ছে অনেক মুসল্লি। দামে সস্তা, স্বাদ, মান এবং গুণেও ভালো হওয়ায় জাত, ধর্ম, বর্ণের বেড়াজাল ডিঙিয়ে আপামর খাদ্যপ্রেমীরা এই এলাকার খাবার উপভোগ করছেন।