করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং নববর্ষে আমাদের প্রত্যাশা

133

এমরান চৌধুরী

কেমন আছেন আপনি? নিশ্চিত উত্তর ভালো নেই। কেমন আছেন আপনারা? এক কথায় জবাব ভালো নেই। এই ভালো না থাকা মানে সবার বুকের গহিন ভিতর কাজ করছে এক ভয়ংকর আতঙ্ক। শুধু কি আমরা? না, কেউ ভালো নেই। বাংলাদেশের কোনো মানুষের মন ভালো নেই। ভালো থাকার কথাও নয়। ভালো নেই আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলো। ভালো নেই রাজার হালে থাকা তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো। ভালো নেই পরাশক্তিগুলো। যাদের পারস্পরিক সংঘাতে এক সময় হিরোসিমা-নাগাসাকির মতো অত্যাধুনিক শহর পলকে পরিণত হয়েছিল ধ্বংসপুরীতে। যাদের দোর্দন্ড প্রতাপে পৃথিবীর কমশক্তিধর এবং অনুন্নত দেশগুলো থাকে সদা ভয়ে তটস্ত, তারা এখন কেউ ভালো নেই। একে অপরকে মারতে, ঘায়েল করতে পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে যারা চব্বিশ ঘণ্টা তৎপর থাকত তারা এখন কেউ ভালো নেই। ভালো নেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের ওপর কামান দাগাতে যারা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল তারাও। একটি অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে তারা সবাই এখন শিশুর মতো অসহায়। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। চোখের সামনে তরতাজা প্রাণগুলো প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে অথচ তারা কিছুই করে উঠতে পারছে না। তাদের চোখে কোনো আলোর ঝিলিক নেই, মুখে কোনো আশার বাণী নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন যন্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। অথচ যারা একদিন আবিস্কার করেছে আকাশপথ, আবিস্কার করেছে জলপথ, মঙ্গলগ্রহে গিয়ে উড়িয়েছে নিজেদের বিজয় কেতন তারা এখন বিষম অসহায়। কীভাবে এই প্রাণঘাতি ভাইরাসের ছোবল থেকে মৃত্যুর মিছিল কমানো যায়, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় বিনীত ও আকুলকণ্ঠে চাচ্ছে পরামর্শ। এ যেন মৃত্যুর মুহূর্তে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার প্রাণপণ প্রয়াস।
এই ভাইরাস তথা করোনা ভাইরাসের কবলে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলো অতিমাত্রায় ঝুঁকির মুখে। এই ঝুঁকির প্রধান কারণ জনসংখ্যার ঘনত্ব। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১০৩ জন লোক বাস করে। বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলা বাদ দিলে অবশিষ্ট ৬১টি জেলা ঘনবসতিপূর্ণ। তারমধ্যে আবার ঢাকা, চট্টগ্রাম আর নারায়ণগঞ্জের জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যাধিক। ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি বর্গমাইলে ৮,১১১ জন লোক বাস করে। নয় বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা যে দশ হাজার ছাড়িয়েছে তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে বান্দরবানে এই সংখ্যা মাত্র ৮৬ জন। আবার যেসব সব শহরে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব আরও বেশি। এবার অনুমান করুন ঢাকার পরে চট্টগ্রাম আর নারায়ণগঞ্জের লোকসংখ্যার ঘনত্ব কত হতে পারে? এই তিনটি শহরের মধ্যে দুটো মহানগরী। ঢাকা বাংলাদেশের ফুসফুস—দেশের রাজধানী, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর—বাণিজ্যিক রাজধানী। এই দুটো মহানগরীসহ নারায়ণগঞ্জে রয়েছে বাংলাদেশের অধিকাংশ পোশাক শিল্প। ফলে বাংলাদেশের এই তিনটি শহর অত্যন্ত জনবহুল। এসব এলাকা ছাড়াও মারাত্মক ঝুঁকির মুখে আছে রোহিঙ্গারা। যারা মগের মুল্লুক থেকে তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব সহজেই অনুমেয়। এই সব দিক বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আজ চরম ঝুঁকির সম্মুখীন।
স্মরণাতীতকালের মধ্যে এটিই একমাত্র প্রচÐ শক্তিশালী ভাইরাস যা নানাভাবে মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে। আগে মহামারি আকারে যে সব রোগ দেখা দিয়েছিল তারমধ্যে কলেরা, ডাইরিয়া ছিল পানিবাহিত, গুটি বসন্ত ছিল বায়ুবাহিত, আর ম্যালেরিয়া ছড়ানোর মাধ্যম ছিল মশা। কিন্তু করোনা ভাইরাসই একমাত্র ভাইরাসে যা ছড়ায় বিভিন্ন মাধ্যমে। মানুষের হাঁচিকাশি, মানুষের সংস্পর্শের পাশাপাশি যেকোনো বস্তুর মাধ্যমেও এই রোগ খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করেছে তার নাম কোভিড ১৯। এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির দেহে হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। কোনো সুস্থ ব্যক্তি যখন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির দেওয়া হাঁচি বা কাশির সূক্ষকণা শ্বাসপ্রশ্বাস বা হাতের স্পর্শের মাধ্যমে মুখে নেন, তখন তার দেহেও করোনা সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত রোগীর লালা, থুথু বা সর্দির ফোঁটা থেকে বিদ্যালয়ের বেঞ্চ বা বাস, ট্রেন বা অন্যান্য যানবাহনের সিট সংক্রমিত হতে পারে। শুধু তাই নয় টেবিল, দরজার হাতল, মুঠোফোন, কম্পিউটারের কি বোর্ড থেকেও তা মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। এখানেই আমাদের যত সমস্যা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো মহানগরীতে শতকরা দশভাগ ভাগ্যবান ছাড়া অন্যরা সবাই থাকে গাদাগাদি করে। বস্তি এলাকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। ১২/১৪ ফিট আয়তনের এক একটি কক্ষে থাকে কমপক্ষে ছয়জন লোক। কোনো কারণে এদের একজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হলে পুরো বস্তি হয়ে পড়বে নরকের সম্মুখীন। তাছাড়া বাঙালিদের অনেককাল আগে থেকে একটা দুর্নাম আছে। আমরা সচেতন নই। সরকার যা বলে আমরা তার উল্টোটাই করি। স্বাস্থ্য বার্তার প্রতি আমরা থোড়াই কেয়ার করি। বলা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। সেই আদেশ বা পরামর্শ গ্রহণের পরিবর্তে আমরা ছিপাগলির ভেতর ঢুকে হাঁঢুর ওপর হাঁঢু তুলে জমিদারি স্টাইলে আড্ডা মারি। ছিপা চায়ের দোকানে ছয় ফুটের মতন লম্বা টুলে বসে সামাজিক দূরত্বকে আরও নিবিড় করে একসঙ্গে খোশগল্পে মাতি। কাঁচা বাজার বা মুদি-দোকানে একজনের মাথা ডিঙ্গিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে আরেক জনের হাত। পোশাক শিল্পগুলো যেন করোনামুক্ত। এই খোলা আর এই বন্ধ করার চলছে কানামাছি খেলা। গ্রাম-গঞ্জের অবস্থাও তথৈবচ। সবার মানসিক অবস্থাটা যেন বিপদ সংকেতের মতো। এখনো দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের অনেক বাকি। আর একটু আড্ডা মেরে নিই। যেখানে কমপক্ষে এক মিটার দূরত্ব বজায় রেখে পরস্পরকে চলাফেরা করতে বলা হচ্ছে সেখানেই এই হচ্ছে বাঙালির সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সাবান পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেÐ হাতধোয়ায় কথা বলা হচ্ছে। আমাদের কী সে সময় আছে, মনে হয় না? যে দোকানি সকাল থেকে বেচাকেনা শুরু করেছে সে কয়বার হাত ধুয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায় একবারও না। হাঁচি কাশির সময় শিষ্টাচার বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। আমরা কতজন তা পালন করছি বা মেনে চলছি। সর্বোপরি আমরা যতটা ধর্মপ্রাণ তারচেয়ে বেশি ধর্মান্ধ। ধর্মের শাশ্বত বাণীর মর্মার্থ উপলব্ধি ও অনুসরণের পরিবর্তে মেতে উঠি অপব্যাখ্যায়। মানুষের ভালোর জন্য দিনে লক্ষ লক্ষবার স্বাস্থ্য বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন এবং ঘরে থাকুন। আমরা যদি না শুনি না মানি তবে ক্ষতিটা কার হবে ? নিশ্চিত আমাদেরই। আমরা যদি মনে করে থাকি মরব যখন দু’দশ জন নয়, শত শতজনকে নিয়ে মরব, তাহলে আমাদের কপালে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নেই। ইংরেজিতে একটা কথা আছে God help those who help themselves. সুতরাং আমাদের আগে নিজেদের ভালো থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকতে হবে তবে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক আমাদের সাহায্য করতে পারেন, অন্যথায় নয়।
এই অবস্থায় আমরা কাল বরণ করতে যাচ্ছি একটি নতুন বছরকে। আমরা বরণ না করলেও কালের পরিক্রমায় বছরটি কাল এসে যাবে ঠিক ঠিকই। প্রতি বছর নতুন বছরকে আবাহন জানাতে বেশ কয়েকদিন আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে থাকে। কারণ নববর্ষ আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির এক বর্ণাঢ্য উৎসব। বাঙালির এই সার্বজনীন উৎসব নববর্ষকে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালিমাত্রই আবাহন করে প্রাণের স্পন্দনে, গানে-, কবিতায়, আবেগের উত্তাপে-উচ্ছাসে। চৈত্রের অবসানে নতুনের বার্তা নিয়ে আমাদের জীবনে নতুন বছরের আগমনী সুর বেজে ওঠে। সে সুর নতুনকে বরণ করার, পুরাতনকে পেছনে ফেলে নব উদ্যমে আগামীকে আবাহন করার। বৈশাখ নানাভাবে আমাদের আলোড়িত করে। বৈশাখ তার নিজস্ব ঢঙে মানুষকে উদ্দীপিত করে। একইসঙ্গে বৈশাখের উন্মাতাল রূপ প্রকৃতিকে ভিন্নমাত্রা এনে দেয়। বৈশাখের প্রচÐ রুদ্রমূর্তি বাঙালিকে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, অন্যদিকে বাঙালির মধ্যে এক ধরনের যুদ্ধ করার মানসিকতা তৈরি করে। তাকে নতুন উদ্যমে আকৃষ্ট করে, করে বেগবান। বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার নাম তাই বৈশাখ।
বাঙালির জাতিসত্তা বিশ্লেষণ করলে আমরা তাই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই, আর তা হলো বাঙালি ধ্বংসের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। লড়াই করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। ধ্বংসস্তুপের মধ্যেও সে নতুন প্রাণের সন্ধান করে। মূলত বৈশাখের রূঢ় তাÐব এবং এর পরবর্তীতে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো সব কিছুই একই সূতোয় গাঁথা। হাজার বছর ধরে বাঙালি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই করেছে তেমনি প্রকৃতির শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও প্রমাণ করেছে বাঙালি জয়ী হতে জানে। বাঙালি বরাবরই লড়াকু জাতি। আর তাই আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আর এজন্যে আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে ঘরে। কারণ এই লড়াইয়ে জিততে হলে ঘরে থাকার কোনো বিকল্প নাই। অচিরেই এদেশ করোনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা হৃদয়ে প্রোথিত করে নববর্ষকে আহবান জানাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-

এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি,ঘুছে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক