করোনায় শিক্ষাখাতে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষতি ৮ লক্ষ কোটি টাকা

11

 

আগ্রাবাদের চেম্বার অব কমার্স ভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে চলছি। দ্রুতপায়ে বেশ সুশ্রী-সুবেশি-স্মার্ট এক তরুণ- যার বয়স ২০-২২ বছরের বেশি নয়, আহন জানালো- আঙ্কেল, ভালো শার্ট আছে। মাত্র ২০০টাকা। গার্মেন্টস্-এর প্রোডাক্ট। এক্সপোর্ট কোয়ালিটি।
থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম- বেশ আকর্ষণীয় সম্ভার ভ্যানে সাজিয়ে, মার্জিত রঙের শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরিহিত নিষ্পাপ চেহারার তরুণটি বেশ ইম্প্রেসিভ। সম্প্রতিভ। বাচন ভঙ্গীর এক্সেন্টও আঞ্চলিকতা মুক্ত। মেরুন রঙের একটি শার্ট পছন্দ হলো। বললাম, কম কতো হবে ? আমাদের চিরাচরিত দস্তুরমাফিক দরাদরি করতে চাইলাম। ইমন নামের ছেলেটি জানায়- মাত্র ২০ টাকা প্রফিটে বিক্রি করছে। তাই ১ টাকাও কম হবে না। ছেলেটিকে মোটেও পেশাদার ফেরিওয়ালা মনে হলো না। বললাম, ‘আচ্ছা দাও।’
গায়ে থাকা পুরোনো শার্টটি খুলে নতুনটি পরি। তরুণ বলে, ‘বাহ্, বেশ মানিয়েছে।’ টাকা দেওয়ার পর বললাম, ‘তোমার নাম কী ? বাসা কোথায় ? কী করো?’
জানতে পারলাম- ওর নাম ইমন। বাসা- মোগলটুলি। সিটি কলেজে ২য় বর্ষের ছাত্র। করোনাকালীন অর্থ-সংকট ও রূঢ় বাস্তবতায় ফেরিওয়ালার পেশা বেছে নিয়েছে।
শুনে বেশ ভালো লাগলো। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে আসতে ভাবলাম, যাক, আমাদের সমাজে ও মানসে জেঁকে বসা বদ্ধমূল ‘ফল্স প্রেস্টিজ’ বা ‘বায়বীয় সম্মানবোধ’- যাকে বলা যায়- কোনো পেশাকে হেয় না করার প্রবণতা দূরীভূত হয়েছে। তাই আমাদের আগামী প্রজন্ম দিয়ে আর শঙ্কার কোনো কারণ নেই। যুগের মুক্ত হাওয়ায়, খোলা বাতায়নে, বিশ্বায়ন বা বিশ্বগ্রামের কনসেপ্টের নিরিখে আগামী দিনের তরুণকুল যে কোনো পেশাকেই হেয় ভাবতে নারাজ। ওদের মনে মনে টুটি-খোলা স্যালুট জানাই।
২. এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। গাণিতিক হিসেবে ১ মিলিয়ন মানে ১০ লক্ষ, আর ১ বিলিয়ন হলো ১০০ মিলিয়ন- যার অংক দাঁড়ায় ১০০ কোটি। আর ১ ট্রিলিয়ন ১০০০ বিলিয়ন। তাতে কতো কতো- কোটি টাকা হয়, বার বার জন্যে খাতা-কলম বা ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হয়।
সংখ্যাতত্তে¡র এসব কচকচি বাদ দিয়ে আসল বিষয়ে আসা যাক। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের একটি রিপোর্টে এসেছেÑ কোভিড-১৯ এর কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল শিক্ষাখাতে ক্ষতির পরিমাণ হলো ১ ট্রিলিয়ন ডলার। আমাদের দেশীয় টাকায় যার অংক দাঁড়ায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দীর্ঘকালীন স্কুল বন্ধের কারণে, যে শিক্ষাসংকট হয়েছে এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হলো ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের পুরো ১টি বছর নষ্ট হয়েছে এই মহামারির কারণে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা দপ্তরের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, স্কুল বন্ধ থাকায় প্রতিজন বাংলাদেশি ছাত্রের পুরো বছরে ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার টাকারও বেশি। যা তাদের পরিবারের এবং সামগ্রিক দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেবে আরো।
শহর ও গ্রামের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অনলাইন-শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে ডিজিটাল ডিভাইসের চাহিদা মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করে এই আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বব্যাংকের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেটের অংক বেড়ে গেছে। এই বেড়ে যাওয়া খাতের মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। শুধুমাত্র শিক্ষা খাতেই বাজেট বাড়াতে হবে।
‘কোভিড-১৯’ এর জন্য আয় হারিয়ে ৫৫ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে (Drop out)। যা সারা বিশ্বের মোট ড্রপ আউটের অর্ধাংশ। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস, বসন্ত-২০২১’ এ দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনে দক্ষিণ এশিয়ায় পারিবারিক সন্ত্রাস বেড়ে গেছে এবং মেয়েদের শিক্ষার হার কমিয়ে দিয়েছে। উদ্ভ‚ত এই সঙ্কট যথাবিহিত ও দক্ষতার সাথে মোকাবিলার জন্যে দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা বাজেট তেমন প্রস্তুত নেই। এতদ্ অঞ্চলের সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কর্তৃক বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রকৃত অংক ২ থেকে ৪ শতাংশ কমানো হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, ভারতীয় কেন্দ্রীয় বাজেট শিক্ষাখাতে বেড়েছে ১২ শতাংশ। প্রচন্ড আশংকার বিষয় হলো এই যে- রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে করোনা ‘ভাইরাস ডিসিজ’ বা কোভিড- ১৯ এর কারণে স্কুল শিক্ষার্থীদের পুরো শিক্ষাবর্ষই বরবাদ হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিডের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে মোট ক্ষতির পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন ডলার মানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো ওঠে এসেছেÑ দক্ষিণ এশিয়ায় ৩১১ মিলিয়ন শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। তাদের অধিকাংশই পারিবারিক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় নিজেরাই উপার্জনে নেমে পড়েছে। অনেক পরিবারের আয় তো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিবারের তরুণ সদস্যরাই সংসারের ভরণ-পোষণের কঠিন দায় মাথায় নিয়ে যথাতথা, যে কোনো উপায়ে, যে কোনো কাজের মাধ্যমে, বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ সংগ্রহের জন্যে কর্মবাজারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। উৎসর্গ করেছে তাদের মহামূল্যবান শিক্ষাজীবন তথা আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বা আগামী। যা আমরা আগ্রাবাদের চেম্বার অব কমার্সের রাস্তায় ভ্যানে শার্ট বিক্রয়ে প্রবৃত্ত ইমনের মাঝে প্রত্যক্ষ করেছি।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের বেশির ভাগ স্কুল খোলা। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশগুলোর স্কুলগুলোও খুলে দেওয়ার প্রস্তাব আনা হয়েছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের ১১ মার্চ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ বছরের অধিক সময়কাল স্কুল কলেজসহ অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রয়েছে।
ডিরেক্টরট অব সেকেন্ডারি অ্যান্ড হায়ার এডুকেশন সংস্থা জানিয়েছেÑ টিভি, অনলাইন এবং অ্যাসাইনমেন্ট বেস্ডÑ শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবুও যে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষাবর্ষের, তা কাটিয়ে উঠতে কঠোর ও লাগসই কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। এখণ কিছু মৌলিক প্রশ্ন ওঠে আসে। শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষন ও শিখন প্রক্রিয়া পরিপূরক। আর এটি ‘ওয়ান ওয়ে জার্নি’ নয়। এখানে শিক্ষা পদ্ধতির (Teaching Methodology) মৌলিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক ধাপসমূহের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশের পিটিআই, বিএড, এমএড ডিগ্রি দেওয়া হয় স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউশন থেকে। ওখানে শিক্ষা পদ্ধতির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিষয়সমূহÑ কারিকুলাম, সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত। আর এতেই শিক্ষকরা অভ্যাসবদ্ধ এবং সুদক্ষ। কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই বেপথু কানাগলিতে ঘুরপাক খাওয়ানোর চমৎকার ব্যবস্থা করেছে। অবশ্য এছাড়া কোনো গত্যন্তরও নেই।
পরিণতি কী ? আমরা একটি শিক্ষাহীন, দক্ষতাবর্জিত, অনালোকিত, কর্মবাজারে সম্পূর্ণ অযোগ্য ও দিশেহারাÑ বলা যায় প্রতিবন্ধী-বিকলাঙ্গ একটি প্রজন্ম পাবো আগামীতে। যাদের পেশাগত জীবন অতল অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
আগ্রাবাদের ইমন এবং আরো এমন লক্ষ লক্ষ ইমন একদিন হয়তো উন্নতির স্বাভাবিক ক্রমবিকাশে ফেরিওয়ালা থেকে দোকানদার হবে। দোকানদার থেকে বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে, রূপান্তরিত হবে ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’ এক মানবসম্পদের প্রতিভূ। যারা আধুনিক যুগের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্পূর্ণভাবে অক্ষম ও অযোগ্য।

লেখক: কলামিস্ট