এবার দেবীর বিদায় নৌকায় শস্যপূর্ণ হবে পৃথিবী

7

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে গতকাল বুধবার শেষ হয়েছে হিন্দু স¤প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মানুষের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা বিসর্জন দেয়াই মূলত বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য। এ প্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য।
চন্ডীপাঠ, বোধন ও অধিবাসের মধ্যদিয়ে ষষ্ঠী তিথিতে ‘আনন্দময়ীর’ আগমনে গত ১ অক্টোবর থেকে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। পরবর্তী ৫ দিন চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপি পূজামন্ডপগুলোতে পূজা-অর্চণার মধ্যদিয়ে ভক্তরা দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এবার দেবী দুর্গা জগতের মঙ্গল কামনায় গজে (হাতি) চড়ে মর্ত্যালোকে (পৃথিবী) আসেন। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড় বৃষ্টি হবে এবং শস্য ও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে স্বর্গে বিদায় নেন নৌকায় চড়ে। যার ফলে জগতের কল্যাণ সাধিত হবে। শস্যপূর্ণ হবে পৃথিবী। বুধবার সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে দর্পণ-বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। পরে বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী ফিরে গেলেন স্বর্গলোকের কৈলাসে স্বামীর ঘরে। পরের বছর শরতে আবার তিনি আসবেন এই ধরণীতে যা তার বাবার গৃহ।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতসহ মহানগরী ও জেলার অন্যান্য স্থানে অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়। গতকাল দুপুর থেকে প্রতিমা বিসর্জন শুরু হয়। প্রতিমা বিসর্জনকালে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। ভক্তদের অংশগ্রহণে প্রতিমা বিসর্জন স্থল হাজারো মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। বিসর্জন উপলক্ষে পতেঙ্গা সৈকতে সকাল থেকে ভিড় জমাতে শুরু করে দর্শনার্থীরা। দুপুর গড়াতেই লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে পতেঙ্গা সৈকত। বেলা বাড়তেই পতেঙ্গা সৈকতে বাড়তে থাকে ট্রাকের সারি সারি। এসময় দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবকরাও ছিলেন বেশ তৎপর। প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে পতেঙ্গা সৈকতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহানগর পূজা পরিষদের সভাপতি লায়ন আশীষ কুমার ভট্টাচার্য।
ধর্মীয় রীতি মেনে নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ছাড়াও ফিরিঙ্গিবাজার নেভাল-২, অভয়মিত্র ঘাট, কাট্টলী ও কর্তফুলী নদীর কালুরঘাট সেতু এলাকায়সহ ১০টি স্থানে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। সকাল থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন পূজামন্ডপ থেকে বিসর্জনের জন্য ট্রাকে করে প্রতিমা নিয়ে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ভক্তরা জড়ো হতে শুরু করেন পতেঙ্গা সৈকতে। এরপর শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জনের পালা।
এর আগে সকালে দশ উপাচারে দেবীর বিহিত পূজা ও দর্পণ বিসর্জন সম্পন্ন হয়। এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় শারদীয় দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। পরে দেবীর চরণে ফুল, সিঁদুর, বেলপাতা ও মিষ্টি দিয়ে বিভিন্ন আচার পালন করে ভক্তরা। লাল রঙকে শক্তির প্রতীক হিসেবে মনে করে নারীরা একে অপরের মাথায় সিঁদুর ছোঁয়ান। দীর্ঘায়ু কামনা করেন পরিবারের সদস্যদের।
এদিকে প্রতিমা বিসর্জন নির্বিঘ্ন করতে বিভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণ করে প্রশাসন। পতেঙ্গা থানার ওসি মো. মাহফুজুর রহমান জানান, শান্তিপূর্ণভাবে সাগরে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। সৈকত ও আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি লায়ন আশীষ কুমার ভট্টাচার্য বলেন, এবছর চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান পূজামন্ডপ জেএম সেন হলসহ ১৬টি থানায় ব্যক্তিগত, ঘটপূজাসহ ২৮২টি পূজামন্ডপে পূজা উদযাপন হয়। পরিষদের পক্ষ থেকে সবাইকে বুধবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। প্রতিমা বিসর্জনকালে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছর করোনার কারণে পূজার্থীরা প্রতিমা বিসর্জনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এ বছর কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় সকলে নির্বিঘেœ বিসর্জন দিতে পেরেছে।
এদিকে প্রতিমা বিসর্জন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সহযোগিতায় সিটি করপোরেশন পতেঙ্গা সৈকতে অস্থায়ী প্যান্ডেল তৈরি, আলোকসজ্জা, প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। এদের মধ্যে ছিল প্রায় ৩শ পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি র‌্যাব, কোস্টগার্ড, ডিবি, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। অন্যদিকে আজ বুধবার) বিজয়া দশমীতে পূজামন্ডপগুলোতে আনন্দের পাশাপাশি ছিল বিদায়ের বিষন্নতা। সকালে দশমীর পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি ও শান্তির জল গ্রহণের মাধ্যমে শেষ হয় দর্পণ বিসর্জন।
এরপর বিবাহিত নারীরা পরিবারের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গার কপাল-চরণে তেল-সিঁদুর ও মুখে পান-মিষ্টি দেন। এছাড়া শিক্ষার্থীরা ১০৮ বার লেখা ‘শ্রী শ্রী মা দুর্গা’ চিরকুট দেবীর হাতে গুজে দেন। পরে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠে ছোট-বড় সবাই। এসব আনন্দের স্মৃতি মুঠোফোনে তুলে নিতে ভুল করেনি অনেকেই। আবার কেউ কেউ সেসব ছবি পোস্ট করেছেন নিজের ফেসবুকে।
সনাতন ধর্ম মতে, অম্বিকা, রুদ্রাণী, উমা, ভবানী, কন্যাকুমারী, কাত্যায়নী, জয়দুর্গা— নানা নামে সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মাঝে আসেন তিনি। মন্ডপে মন্ডপে শিল্পীর তুলিতে রূপের পার্থক্য, কারুকার্য বিভিন্ন রকমের হলেও বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তিনি অতি একান্ত আপনজন, তিনিই ঘরের মেয়ে উমা।
বিপত্তারিণী দেবী ষষ্ঠীতে প্রাণ সঞ্চারণার মধ্য দিয়ে ভক্তদের মাঝে এসে অধিষ্ঠিত হন। সিঁদুর খেলা শেষে বিসর্জনের শোভাযাত্রায় ভক্তরা কৈলাশের পথে এগিয়ে দেন বিপদনাশিনী মা দুর্গাকে। আর এর মধ্যেই সাঙ্গ হলো সনাতনী ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বা পার্বণ বলে পরিচিত শারদীয় দুর্গোৎসব।
সনাতনী শাস্ত্র অনুযায়ী, এবার দেবীদুর্গা জগতের মঙ্গল কামনায় গজে (হাতি) চড়ে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছেন। পঞ্জিকামতে, দেবী যদি গজে চড়ে মর্ত্যে আসেন তাহলে তিনি সঙ্গে করে সুখ, সমৃদ্ধি নিয়ে আসেন। হাতি হচ্ছে জ্ঞান ও সমৃদ্ধির প্রতীক। আর গতকাল বিজয়া দশমীতে দেবী কৈলাসের উদ্দেশ্যে মর্ত্য ছাড়েন নৌকায় চড়ে। নৌকায় চড়ে মর্ত্য ছাড়লে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। পৃথিবী হয়ে ওঠে শস্য-শ্যামলা। কিন্তু সেই সঙ্গে অতি বর্ষণ বা প্লাবনের আশঙ্কাও দেখা দেবে।