এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিন

7

চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাণিজ্যিক নগরীখ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অধিবাসীদের জন্য বায়ুদূষণের কারণে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু এ ব্যাপারে যে কিছু করা দরকার, এমন কোন তাগিদ কর্তৃপক্ষের কাছে লক্ষ করা যাচ্ছে না। গতকাল রবিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ দিনই চট্টগ্রামের বায়ুর মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল। এর দশ বছর আগে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮ দিন চট্টগ্রামের বায়ুর মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল। অর্থাৎ ঠিক দশ বছর পরে সে মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। এছাড়া ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছিল ১২ দিন। একইভাবে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১২দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বায়ুদূষণ সতর্কতা ছিল ৩ দিন, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা ছিল ১ দিন। প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ বেশি করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাছাড়া দশ বছরে জনসংখ্যা, আবাসিক ভবন নির্মাণ, গাড়ির সংখ্যাসহ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কারখানা স্থাপনও। এসব কারণে চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ বেড়েছে।
লক্ষ করা যায়, শুষ্ক মৌসুমে নগরীর উন্নয়ন ও সেবা সংস্থাসমূহ তাদের বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। যেমনটি জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সড়ক উন্নয়ন ও সংস্কার, ওয়াসার পানির সংযোগ ও গ্যাসের সংযোগ দিতে গিয়ে নগরীর অধিকাংশ এলাকাতেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে সিডিএ, ওয়াসা, কর্ণফুলী গ্যাস, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা। ওয়াসা ও কর্ণফুলী গ্যাসের লাইনের কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, কোনও কোনও এলাকার রাস্তা কেটে পানি বা গ্যাস লাইনের সংযোগ দেয়ার পর মেরামত না করে ওভাবেই ফেলে রেখে চলে যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে গাড়ি চলাচলের ফলে সেখানে তৈরি হচ্ছে ধুলাবালি। নির্মাণাধীন এলাকায় নিয়মিত পানি ছিটানোর জন্য আইন থাকলেও সেগুলো মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন পয়েন্টে উন্নয়ন প্রকল্পের চলমান কাজ থেকে সৃষ্ট ধুলায় নাকাল যাতায়াতকারীরা। তাছাড়া ফিটনেস বিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে বায়ু দূষেণের মাত্রা বেড়ে যায়।
বিআরটিএর তথ্যমতে, নগরীতে প্রায় ২ লাখ ১৯ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এরমধ্যে রয়েছে ৩৬ হাজার ৭৭৯টি ফিটনেস বিহীন যানবাহন। কালো ধোঁয়া বা কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস উৎপাদনকারী যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এরমধ্যে এ ক্ষতিকর গ্যাস ছড়ানো ফিটনেসবিহীন ট্রাক ৪ হাজার ৫৯টি, অটোটেম্পু ৬ হাজার ৯১৫টি, পিকআপ প্রায় ৪ হাজার ৫০৭টি চলাচল করে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাতাসে ধুলাবালির সাথে যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় থাকা কিছু ভারি ধাতু অক্সাইড ফুঁসফুস, হার্ট ও কিডনিকে অকেজো করে দিতে পারে। এর ফলে স্ট্রোক, হার্ট, কিডনি জটিলতার রোগী বেড়ে গেছে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান পূর্বদেশকে বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের একটা নগরীকে ধ্বংস করে ফেলছে। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ আইন মেনে নির্মাণ কাজ হয়। অথচ এদেশে যে যার মত করে পরিবেশকে ধ্বংস করে নির্মাণ কাজ করে। শুধু বাতাস না, আমরা সকল ধরনের দূষণের শিকার। এ শহরের প্রতি কারো দায়বদ্ধতা নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দূষিত শহর রেখে যাচ্ছি। এ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরবর্তী দশ বছরে দূষণ তিন থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ ড. অলক পাল বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে এককাজ দুইবার করতে হয় বলে ধুলোবালির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং তা স্থায়ী রূপ নেয়। তাছাড়া যানবাহন আর কল-কারখানার ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণ বেড়েছে। বায়ুদূষণের ফলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। দিন দিন হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বাড়ছে। তার মতে, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বের মত বায়ু দূষণরোধে একটি শক্তিশালী এনফোর্সমেন্ট গঠন করা যায়। যার মাধ্যমে নিদিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি বায়ু দূষণ করলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। গত মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত মেগাসিটির তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা এরপর চট্টগ্রাম। গত অক্টোবরে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত অসুখে বছরে সাড়ে আট হাজার শিশু মারা যায়। চিকিৎসকদের মতে, বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে গেলে আমাদের স্ট্রোক, হার্টের অসুখ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদির ঝুঁকি বেড়ে যায়। মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টির একটি বড় কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। বিশেষ করে ফুসফুস ও মূত্রাশয়ের ক্যানসারের অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। এই নগরীর বায়ুদূষণের জন্য দায়ী মূলত মানুষ। পরিকল্পনাহীন কর্মকান্ডের ফলে আজকে নগরীর পরিবেশের এই হাল। এখনই সচেতন না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এ জন্য সরকারসহ নগর পরিকল্পনাবিদদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে যখন-তখন কেউ যেন রাস্তা খুঁড়তে না পারে। যথাযথ বিধি মেনে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে। ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা ও যানবাহনে নিম্নমানের জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।