একটি সাদা এপ্রোন আর একটি স্টেথোর হাহাকার

6

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(শেষ পর্ব)
(৬) উপজেলা হাসপাতালসমূহে চিকিৎসকের চেম্বার এবং অফিস অরক্ষিত থাকা : অন্যান্য বিসিএস ক্যাাডারদের অফিসের সামনে যেভাবে নিরাপত্তারক্ষী রাখার ব্যবস্থা সরকার করেছে চিকিৎসকদের অফিসের সামনে সে রকম নিরাপত্তা রাখার ব্যবস্থা সরকার করেনি।এর ফলে যে কোন ব্যক্তি বিনাঅনুমতিতে চিকিৎসকদের চেম্বারে বা অফিসে প্রবেশের সুযোগ পায়।
ঙ) দলীয় রাজনীতির প্রভাব : রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে লালিত এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে সদর্পে বিচরনরত সন্ত্রাসীদের কর্তৃক নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি জনগণকে প্রদর্শন করার জন্য নিরীহ চিকিৎসক এবং অরক্ষিত চিকিৎসালয়কে সন্ত্রাস প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়া:
উপজেলা হাসপাতালসমূহে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের কিছু কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদ পুষ্ট থাকেন। তাঁরা হাসপাতাল প্রশাসনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বে অবহেলা করে এবং বিবিধ দুর্নীতি করে। তাদের অবহেলা এবং দুর্নীতি দ্বারা রোগীদের ভোগান্তি বাড়ে।রোগীদের ক্ষোভ থাকে স্বাভাাবিক ভাবেই চিকিৎসকদের উপর। রোগীর স্বজনরা নীরিহ চিকিৎসকদের মারধর করে। আরো দেখা যায়,স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সবাই নিজ নিজ স্বার্থে রাজনীতিবিদগনের প্রশ্রয়ে থাকা মাস্তানদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে সাহস করে না। মাস্তানরা প্রশাসনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে চলে। মাস্তানরা মেডিয়া কাভারেজ পেয়ে নেতাদের পছন্দের তালিকায় থাকার জন্য মারামারির ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়।এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যেহেতু সবচেয়ে অসহায় তাদের উপর মাস্তানরা চড়াও হয়।
চ) ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না হওয়া: কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক নিপীড়ন ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরের ঘটনা রোধে ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সময়ের দাবী হলেও প্রশাসনিক আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা হচ্ছে না।
উপজেলায় যোগাযোগ সমস্যা- (১) রাস্তাঘাটের বেহাল দশা: উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্প,ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্থ থাকে।
একজন নারী চিকিৎসক সকাল নয়টায় শহর থেকে রওয়ানা দিলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দুপুর  সাড়ে বারটার আগে পৌঁছতে সক্ষম হবেন না।চিকিৎসককে বিশেষত নারী চিকিৎসককে যদি সন্ধ্যার মধ্যে শহরে পেীঁছতে হয় তবে তাঁকে বেলা দুটোর মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ত্যাগ করতে হবে। এখানে খেয়াল করার ব্যাপার হচ্ছে যে, দীর্ঘসময় ব্যয় হবার কারন পথের দূরত্ব নয়, বরং সড়কের ভগ্নদশা ও ত্রুটিপূর্ণ বাহন। স্বাস্থ্্যকেন্দ্রের অবস্থান যতো দূরেই হোক না কেন সেখানে অবশ্্যই চিকিৎসক যাবেন এবং চিকিৎসা দেবেন।এটা পেশাগত, চাকুরীগত ও মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু সেখানে যাবার রাস্তার ভগ্নদশা দেখার দায়িত্ব কার ? সেখানে যাবার বাহনের সমস্যা দেখার দায়িত্ব কার ?
(২) সরকারী বাহনের ব্যবস্থা না থাকা : একজন নারী চিকিৎসকের জন্য ত্রুটিপূর্ণ ভাংগাচোরা টেস্পুতে ভগ্নদশা প্রাপ্ত সড়কে চলাফেরা করা কতটুকু যুক্তিসংগত ও সন্মানজনক এটা কারা দেখবে? বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে সময়মতো ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সময়মতো পৌঁছতে না পেরে গর্ভবতী মহিলা ও জরুরী রোগীদের অবস্থা আরও সংকটাপূর্ণ হয়ে পড়লে বা মৃত্যু হলে তার দায় কে নেবে ? মহিলা চিকিৎসকদের জন্য সরকারী পরিবহনের ব্যবস্থা না থাকায় বেসরকারীভাবে গাড়ী ভাড়া করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে দুপুর ফিরে আসতে সন্ধ্যা নাগাদ প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয় এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। সরকারী কোন ট্রানসপোর্ট সুবিধা না থাকায় তিনি হয় হেঁটে অফিসে যান, নতুবা সারাদিনের জন্য রিক্সা ভাড়া করে নেন।অনেক জায়গা আছে যেখানে যেতে হলে নৌকা ছাড়া যাওয়ার আর কোন সুযোগ নেই।
উপসংহার : নারী চিকিৎসকদের বিবিধ সমস্যার সমাধান যে ভাবে করতে হবেÑ শুধু স্বামী নয়, পরিবারসহ আত্মীয় স্বজনদেরও বুঝতে হবে যে, একজন নারী চিকিৎসক একই সংগে সংসার, লেখাপড়া, চাকরী সামলাতে হয়, যা ভীষন কঠিন। ঘরের কাজে পুরুষদের উচিৎ স্ত্রী এবং মাকে সাহায্য করা। হাসপাতালে রাত্রিকালীন নারী ডিউটি ডক্টরদের কর্মপরিবেশ নারী বান্ধব হতে হবে।
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্ম যৌনরোগে
স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম