ঈদের বাজারে শুল্ক ফাঁকির পণ্য

6

 

পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামসহ দেশের বাজারগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় পোশাক-প্রসাধনী ও ভোগ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদা থাকে। হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার ঈদের বাজারে অধিক লাভের লোভ সংবরণ করতে না পেরে ব্যবসায়ীদের অনেকে সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিদের সহায়তায় চোরাপথে দেশের বাজারে পণ্য নিয়ে আসেন। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চোরাপথে নিয়ে আসা পণ্যের কয়েকটি চালান জব্দ হলেও চাহিদার বড় অংশই নির্বিঘ্নে বাজারে চলে আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি বলে মনে করছেন বাজার-বিশ্লেষকরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে ‘ম্যানেজ’ করে স্থল ও জলপথে সীমান্ত পেরিয়ে এসব পণ্যের চালান নিয়ে আসা হয়েছে। চোরাপথে আসা এসব পণ্য এখন শোভা পাচ্ছে নগরী ও জেলার বিভিন্ন মার্কেটে। এসব পণ্যের তালিকায় শাড়ি ও থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন পোশাক, নানা ব্র্যান্ডের প্রসাধনী, কয়েক ধরনের মসলা এবং বিলাসী দ্রব্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে।
এদিকে, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা পণ্য জব্দে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভাগীয় চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স নগরীর বৃহত্তম বাজারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে আসলেও এবার এখনো পর্যন্ত কোথাও অভিযান পরিচালনার খবর মিলে নি। ঈদ বাজারে সম্ভাব্য অসন্তোষ এড়াতে এবার টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে অঘোষিতভাবে অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে নগরীর দেওয়ানজী পুকুর পাড়ের একটি শপিং মলে বড় ধরনের অভিযান চালায় চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স। এরপর তৈরি পোশাক ও প্রসাধনীর জন্য বিখ্যাত নগরীর টেরীবাজারের কয়েকটি শপিং মলে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে তাদেরকে বাধার মুখে পড়তে হয়। এসময় ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং সংঘর্ষ বেঁধে যায়। তখন ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স এনে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। মূলত এরপর থেকেই রমজান ও ঈদের বাজারে চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযান অঘোষিতভাবেই বন্ধ রয়েছে।বাজার-সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে ভোগ্য ও মসলজাতীয় পণ্যের পাশাপাশি পোশাক-আশাক, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বাজারে দেশি পণ্য ছাড়াও বিভিন্ন ডিজাইনের ভারতীয় পোশাকসহ বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর ব্যাপক চাহিদা থাকে। আর ব্যবসায়ীদের অনেকেই চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পণ্য চোরাপথেই যোগান দিয়ে হয়ে থাকেন। বৈধ পথে আমদানির পাশাপাশি চোরাকারবারি চক্র শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এসব পণ্য স্থল, নৌ ও আকাশপথে দেশের বাজারে নিয়ে আসে। অধিক মুনাফার লোভ সামলাতে না পেরে ব্যবসায়ীদের অনেকেই চোরাকারবারি চক্রের আনা পণ্যের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েন। তাছাড়া, বৈধ পথে শুল্ক পরিশোধ করে আনা পণ্যের বিক্রয়মূল্যের চেয়ে চোরাপথে আনা পণ্যের দাম তুলনামূলক কম থাকায় নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রাখা যায়। এ কারণে চাহিদার বিভিন্ন পণ্য শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাপথে দেশের বাজারে নিয়ে আসে চোরকারবারিরা। নির্ধারিত গুদামে মজুদ করার পর সেখান থেকে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী এসব চোরাপথে আনা পণ্য বাজারে সরবরাহ করা হয়। নগরীর বিলাসবহুল বিপণী কেন্দ্র থেকে শুরু করে টেরিবাজার, রেয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেটেও অধিকাংশ দোকানে চোরাপথে আনা পণ্য শোভা পাচ্ছে।
নগরীর ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ে রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে মসলাজাতীয় পণ্যের ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। ছোলা, ডাল ও ভোজ্যতেলের পাশাপাশি এলাচ, দারুচনি, লং, খেজুর, কাজু বাদাম, কিসমিসসহ মুখরোচক বিভিন্ন খাদ্যপণ্য এ বাজার থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। এসব পণ্যের চাহিদার বেশিরভাগই যোগান দেয়া হয় বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছোলা, ডাল ও ভোজ্যতেলের কাঁচামাল আমদানি হলেও মসলাজাতীয় পণ্যের অধিকাংশই আসে চোরাপথে। একইভাবে ভারতীয় শাড়ি, থ্রি-পিস ও প্রসাধনী পণ্যও কুমিল্লা, ফেনী, রামগড়সহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে নিয়ে আসা হয়। উভয়দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ম্যানেজ করেই এসব পণ্য দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী দিয়েও কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে আসা হয় পোশাক ও মসলাজাতীয় পণ্যের চালান। এতে করে, সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। টেকনাফ ও বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের আড়ালেও চোরাচালান হয়ে থাকে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব পণ্যের হাতবদলের অর্থও প্রেরণ করা হয় হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে, সবক্ষেত্রেই সরকার রাজস্ব হারায়। এছাড়া শাহ আমানত বিমানবন্দরে সক্রিয় ‘লাগেজ পার্টি’ নামধারী চোরাকারবারি চক্র দুবাই, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রসাধনী সামগ্রী শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিয়মিতভাবে দেশের বাজারে নিয়ে আসছে। ঈদের বাজারকে টার্গেট করে তাদের তৎপরতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
জেলা চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য এবং পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নুরেআলম মিনা পূর্বদেশকে বলেন, চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত বিজিবিসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে বাড়তি নজরদারি ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রমজানের শুরুতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে, সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলার এসপি ও বিজিবি কমান্ডারদের চোরাচালানের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।