ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব

4

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

ইতিকাফ এক মহাপূণ্যময় ইবাদত। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। বিশ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব হতে ঈদের বাঁকা চাঁদ উদিত হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা সুন্নাতে মোয়াক্বাদায়ে কেফায়া। মহল্লার একজন ইতিকাফ করলে সকলের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যাবে। যদি কেহই ইতিকাফ না করে সকলেই গুণাহগার হবে।
ইতিকাফের আভিধানিক অর্থ কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরা এবং তার উপর নিজেকে ধরে রাখা। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে কোন মুসলমান মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে।
প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহে রমজানের পূর্ণ মাস ইতিকাফ করতেন। রমজানের শেষ দশদিনের ইতিকাফ কখনো তিনি ছেড়ে দেননি।
কোন অসুস্থ ব্যক্তি অথবা মুসাফির রমজানের রোজা না রেখে ইতিকাফ করলে সুন্নাতে মোয়াক্বাদাহ আদায় হবে না। বরং নফলের পুণ্য পাবে। পায়খানা, প্রস্রাব, অজু ও গোসলের সময় ব্যতীত মসজিদের বাইরে যাওয়া ইতিকাফকারীর নিষেধ। প্রয়োজনে মসজিদ হতে বের হলেও কারো সাথে কথা বলতে পারবে না। কাজ সমাধা করে তাড়াতাড়ি মসজিদে ঢুকে যেতে হবে। প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদের বাইরে এক মিনিট থাকলেও ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। ইতিকাফ অবস্থায় কারো সাথে অপ্রয়োজনীয় গল্পালাপ করা নিষেধ। আবার ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে চুপ করে থাকাও মাকরূহ। ইতিকাফকারী মসজিদে কোরআন তেলাওয়াত, ধর্মীয় গবেষনা, দোয়া, দরূদ, এজতেফখার, তজবিহ-তাহলিল, নফল ইবাদত, মোরাকাবা ইত্যাদিতে নিয়োজিত থাকা উচিত। ইতিকাফকারী মসজিদেই খাওয়া দাওয়া করবে, বাইরে খেলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। দুই-একদিন বা দই-একঘণ্টার জন্য মসজিদে ইতিকাফ করা যায় এবং পুণ্যের কাজ। কিন্তু সুন্নাতে মোয়াক্বাদয়ে কিফায়াহ আদায় হবে না।
উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেছেন, ইতিকাফকারীর পক্ষে এই নিয়ত করা কর্তব্য (১) সে যেন কোন জানাজায় উপস্থিত না হয়। (২) কোন পীড়িতকে দেখতে না যায়। (৩) স্ত্রী সহবাস না করে (৪) স্ত্রীর সাথে ঘেষাঘেষি না করে (৫) কোন প্রয়োজন ব্যতীত যেন ইতকাফের স্থান ত্যাগ না করে। সিয়াম সাধনার মত ইতিকাফ ও উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য নতুন কোন বিধান নয়, পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও ইতিকাফের গুরুত্ব ছিল, তাই প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) একবার মসজিদে নববী শরীফে ইতিকাফ করছিলেন। তখন তাঁর নিকট দুঃস্থ এক লোক হাজির হলেন। তার দুঃখের কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুলের চাচাজান এক ব্যক্তি আমার কাছে কিছু হক পাবে তার প্রাপ্য পরিশোধ করার সামর্থ্য আমার নেই’। একথা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, ‘আমি কি তোমার জন্য সুপারিশ করতে পারি’? তিনি বললেন, ‘আপনি যা ইচ্ছা করেন’। একথা শুনেই আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) মসজিদে নববী শরীফ হতে বেরিয়েগেলে লোকটি জানতে চাইলেন, আপনি কি ইতিকাফের কথা ভুলে গেছেন ? তিনি বললেন, ‘না’। অতঃপর কান্না জড়িত কন্ঠে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, বেশি দেরী হয়নি আমি এই স্থানেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, ‘মুসলমান ভাইয়ের প্রয়োজন মেটানো দশ বছরের ইতিকাফ অপেক্ষা উত্তম। আর যে মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে একদিন ইতিকাফ করলো আল্লাহ তাঁর ও দোজখের মধ্যে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। এক খন্দকের দূরত্ব পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের সমান। (তাবরানী শরীফ)।
আলী বিন হোসাইন (রা.) হতে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে মুসলিম রমজানের দশ দিন ইতিকাফ করে সে দুই হজ্ব ও দুই ওমরার সওয়াব পাবে। (বায়হাকি শরীফ)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে আত্ম নিবিষ্ট করতে এবং নির্জনে অবস্থান করে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর ভালোবাসা দ্বারা অন্তরকে আলোকিত করতে ইতিকাফের ভূমিকা রয়েছে।
হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত লাইলাতুল ক্বদর নিহিত রয়েছে এই রমজান মাসে। যে কেউ এই বরকতময় রাত প্রাপ্তির ইচ্ছা করলে সে যেন রমজানে ইতিকাফ করে।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত আছে, ছরকারে দো আলম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক তুর্কী শিবিরে রমজানের রোজার প্রথম দশদিন ইতেকাফ পালন করলেন। অতঃপর মধ্যবর্তী দশদিন করে ইরশাদ করলেন, ‘প্রথম দশদিন ইতিকাফ করে আমি লাইলাতুল ক্বদর সন্ধান করেছি। একই উদ্দেশ্যে মধ্যবর্তী দশদিন ইতিকাফ করলাম। অতঃপর আল্লাহ পাক জাল্লে শানহুর পক্ষ থেকে জানতে পারলাম ক্বদর রমজানের শেষ ক্বদর রমজানের শেষ দশদিনেই রয়েছে। যে ব্যক্তি ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন আমার সাথে রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করে এবং রমজানের শেষ দশদিনের বিজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করে’।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেছেন, ‘এই রাতে বৃষ্টির পানি মসজিদের ছাদ টপকে পড়ছিল। সেদিন একুশ রমজান ভোরে আমি প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কপাল মোবারকে পানি মিশ্রিত ভেড়া মাটির চিহ্ন দেখতে পাই’। অর্থাৎ এই মহান বৃষ্টিভেজা রাতে তিনি কাদায় সেজদা করেছিল। (মিশকাত শরীফ)
আমরা প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস পাক হতে আত্মস্থ করতে পারি যে পবিত্র রমজানে ইতিকাফ করার মহান উদ্দেশ্য হলো লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করা। এবং এই রাতে রমজানের শেষ দশদিনের বিজোড় অর্থাৎ ২১,২৩,২৫, ২৭, ২৯ রাতে সংঘটিত হয়। আল্লাহ পাক জাল্লে শানহু যেন আমাদেরকে মাহবুবে খোদা হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের অনুসরণ করে রমজান, ইতিকাফ এবং লাইলাতুল বরাতের ফজিলত অর্জনের তৌফিক দান করেন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক