আমূল বদলে যাবে যাতায়াত ব্যবস্থা

38

ওয়াসিম আহমেদ

৩৮টি ফুটওভার ব্রিজ, বিমানবন্দর সড়কে ৬শ মিটার ওভারপাস, ১৪টি ব্রিজ, ২২টি কালভার্ট, ১০টি গোলচত্ত¡র, ২টি জিপ ও ১৫টি নির্মাণ যানযন্ত্রপাতি ক্রয় এবং ৭৬৯ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন করবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এ লক্ষ্যে শতভাগ জিওবি’র অর্থায়নে ২ হাজার ৪৯০ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকার (প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা) প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন মেলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার সভাপতিত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। একইসাথে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, মেট্রোরেল শুধু ঢাকাতে থাকবে কেন, ‘চট্টগ্রামের জন্যও মেট্রোরেল প্রকল্প নিতে হবে। যেসব শহরের সঙ্গে এয়ারপোর্ট আছে, সেসব শহরে পর্যায়ক্রমে সংযুক্ত করে প্রকল্প নিতে হবে।’
চসিকের প্রকল্প অনুমোদন নিয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রকল্পটি শতভাগ জিওবি অর্থায়নে করতে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। তারই বদৌলতে চট্টগ্রামের উন্নয়নে তিনি অনুরোধ রেখেছেন। তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হলে নগরীর যাতায়াত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে।’ উল্লেখ্য, এটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে টাকার অংকে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়। করোনার কারণে দীর্ঘদিন থমকে থাকার পর ২০২০ সালের ২৩ মার্চ পুনরায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রস্তাবনা পর্যালোচনা সভায় উত্থাপন করা হয়। অন্যদিকে ম্যাচিং ফান্ডের বোঝা থেকে বাঁচতে ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর প্রথমবারের মত সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়ক নেটওয়ার্কিং উন্নয়নে শতভাগ জিওবি অর্থায়নে ১২৩০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পায়। যেটির বাস্তবায়ন প্রায় শেষের দিকে বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশন সূত্র।

চট্টগ্রামে মেট্রোরেল : ২০১৯ সালে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নগরীতে সর্বপ্রথম মেট্রোরেল করার উদ্যোগ নেন। চসিকের উদ্যোগ মেট্রোরেল নিয়ে প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষে ওই বছর ২৬ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। যেখানে মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা নিয়ে আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়। ওই সময় বলা হয়, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এ দ্রæত গণপরিবহন ব্যবস্থা হবে মেট্রো রেলের তিনটি লাইনে। যার মোট দৈর্ঘ্য সাড়ে ৫৪ কিলোমিটার। তা বাস্তবায়ন করতে আনুমানিক ৮৪ হাজার ২০২ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে। বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালটেন্টস লিমিটেড নামে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রাক-যোগ্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছিল।
ওই সময় সিটি কর্পোরেশনের এমন উদ্যোগে সিডিএকে অনাপত্তি দেওয়ার আহব্বান জানান সিটি মেয়র। তবে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি সিডিএ চেয়ারম্যান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবকে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান মো. জহিরুল আলম দোভাষ। অনেকটা সিডিএ’র অনাগ্রহের কারণে প্রকল্পটি আর আলো দেখেনি বলে জানিয়েছে চসিক সংশ্লিষ্টরা।
বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালটেন্টস লিমিটেড ডেপুটি টিম লিডার মাহবুবুর রহমান জানিয়েছিলেন, কালুরঘাট থেকে বহদ্দারহাট, চকবাজার, লালখান বাজার, দেওয়ানহাট, পতেঙ্গা হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২৬ কিলোমিটার, সিটি গেট থেকে একে খাঁন বাসস্টপ, নিমতলী বাসস্টপ, সদরঘাট, ফিরিঙ্গিবাজার হয়ে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার এবং অক্সিজেন থেকে মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, আন্দরকিল্লা, কোতোয়ালি হয়ে একে খাঁন বাসস্টপ পর্যন্ত সাড়ে ১৪ কিলোমিটার (ম্যাস রেপিড ট্রানজিটের-এমআরটি) মেট্রোরেল লাইন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া সাড়ে ৫৪ কিলোমিটারের তিনটি লাইনে ৪৭টি স্টেশনের প্রস্তাব করা হয়। একেকটি স্টেশনের দূরত্ব হবে ৭০০ মিটার থেকে ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার। ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার গড় গতিবেগ থাকবে মেট্রোরেলের। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটির মাধ্যমে ঘণ্টায় দুই প্রান্তে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব। প্রতিটি এমআরটি লাইনের জন্য ৬০ একরের অর্থাৎ তিনটি লাইনের জন্য ১৮০ একর জায়গা দরকার হবে। জায়গাগুলো হুকুম দখল করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হয়। প্রতিবন্ধকতা গুলো হচ্ছে বহদ্দারহাট-লালখান বাজার সড়কাংশে ইতোমধ্যে সিডিএ কর্তৃক উড়াল সড়ক (ফ্লাইওভার) নির্মাণ করা হয়েছে, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর সড়কাংশে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সিডিএ। এসব প্রতিবন্ধকতার সমাধানে বলা হয়, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চলমান ফ্লাইওভারে কাজ বন্ধ রেখে এমআরটি স্থাপনকে অগ্রাধিকার প্রদান করা, ওই ফ্লাইওভারের ডিজাইন পুনর্বিবেচনা করে সমন্বিতভাবে ফ্লাইওভার ও এমআরটি স্থাপন করা যেতে পারে, ফ্লাইওভারের পাশ দিয়েও এমআরটি নির্মাণ করা যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে ভ‚মি হুকুম দখল, ক্ষতিপ‚রণ ও ইউটিলিটি শিফটিং এর জন্য ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

চসিকের আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প : সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহ উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’, শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে খরচ হবে ২ হাজার ৪৯০ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা (প্রায় ২৫শ কোটি টাকা)। এছাড়া প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে গত বছরের জুলাই ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটিতে ৩৮টি পদচারী সেতুসহ বিমানবন্দর সড়কের অবশিষ্ট অংশ চার লেনে উন্নীতকরণ, ৬০০ মিটার ওভার পাস, বিভিন্ন ওয়ার্ডের ৭৬৯ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন করা হবে।
জানা গেছে, প্রকল্পটির অধীনে বিমানবন্দর সড়কে ড্রাই ডক থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত চার লেনের ৬০০ মিটার ওভারপাস, ৩৮টি ফুট ওভার ব্রিজ, ১৪টি ব্রিজ, ২২টি কালভার্ট, ১০টি গোলচত্ত¡র, ২টি জিপ ক্রয়, নির্মাণ যানযন্ত্রপাতি ক্রয় ১৫টি এবং ৭৬৯ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আরও বলা হয়, কিন্তু রুবি সিমেন্ট গেট থেকে ড্রাইডক পর্যন্ত সড়কের অংশটি স¤প্রসারণ না করায় প‚র্ণাঙ্গ ফলাফল ভোগ করতে পারছে না নগরবাসী। তাই সড়কটির অবশিষ্ট অংশে চারলেনসহ ওভার পাস করার প্রস্তাব করা হয়।
নগরের যেসব জায়গায় ফুটওভার ব্রিজ বা পদচারী সেতু স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে জিইসি মোড়ে ২টি, মুরাদপুর মোড়ে ১টি, ষোলশহর মোড়ে ১টি, ২নং গেটে ২টি, বহদ্দারহাট জংশনে ২টি, কাপ্তাই রাস্তার মাথার মোড়ে ১টি, অক্সিজেন জংশনে ২টি, টেকনিক্যাল মোড়ে ১টি, লালখান বাজার মোড়ে ১টি, টাইগারপাস মোড়ে ২টি, দেওয়ানহাট মোড়ে ১টি, আগ্রাবাদ চৌমুহনী মোড়ে ১টি, বাদামতলী মোড়ে ১টি, নিমতলা মোড়ে ১টি, অলংকার মোড়ে ২টি, একে খান মোড়ে ১টি, সাগরিকা মোড়ে ১টি, নয়াবাজার মোড়ে ১টি, সল্টগোলা ক্রসিং এ ১টি, সিমেন্ট ক্রসিং এ ১টি, কেইপিজেডে ১টি, কাঠগড় মোড়ে ১টি, রুবি গেটে ১টি, কুলগাঁও স্কুলের সামনে ১টি, সিটি গেইটে ১টি, মনসুরাবাদে ১টি, এক্সেস রোডের মুখে ১টি, নাসিরাবাদ সরকারি মহিলা কলেজের সামনে ১টি, আকবরশাহ মোড়ে ১টি এবং সানোয়ারা স্কুলের সামনে ১টির কথা জানা গেছে।