আমিই সেই দীপাবলি কিংবা মাধবীলতা

17

 

ক্লাস এইট পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া কিছু পড়িনি। একজনের লেখাতেই ডুবসাঁতার দিয়ে ছিলাম। ফাইনাল দিয়ে, বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে যেদিন ঘরে ফিরলাম, ভাইয়া একটা বই নিয়ে এল। বলল ‘পড়ো এটা, সময় এসেছে।’ (বলাই বাহুল্য আমার জীবনের কখন কীসের সময় আসবে, সেটা ঠিক করত আমার ভাই। আমি জানতাম একজন আছে তো, সময়মত জানব কখন কী করতে হবে!)
ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বসলাম ‘গর্ভধারিণী’, কী কঠিন, ছোটো ছোটো লেখা। মাথা ব্যথা করে, তাও পড়ে চলেছি, বুঝি বা না বুঝি! ভাইয়া যেহেতু বলেছে…
একদিন গেল, দুইদিন গেল, তিনদিন গেল, চতুর্থদিন থেকে আমাকে আর কেউ পায় না। আমি মোটামুটি হারিয়ে গেলাম পাহাড়ের মাঝে,হয়ে উঠলাম জয়িতা। মেয়েটাকে আমি নিজের ভেতর ধারণ করেছিলাম,আজও ধারণ করে আছি। ভাইয়াকে গিয়ে বললাম ‘পরের বইটা দাও।’ সে হেসে বলল, ‘সময় আসুক’। এসএসসির পর ধরিয়ে দিল ‘উত্তরাধিকার’, এবার তো পুরা আফিম ধরিয়ে দিল যেন! এ কী বাবা! অনিমেষের সাথে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ঘুরছি। তার কষ্টে কাঁদছি,তার সাথে কলেজে যাচ্ছি। মাধবীলতার দিকে যখন তাকায় সে, নিজে মাধবীলতা হয়ে উঠেছি। কত ক্লান্ত দুপুর অনিমেষের সাথে ক্যান্টিনের বদ্ধ কেবিনে কাটিয়েছি! এক টানেই পড়লাম কালবেলা, কালপুরুষ। তিনটা বই শেষ করে অনিমেষকে আর ভুলতে পারি না। অনিমেষ মাথায় গেল গেঁথে। ভালোবাসলে মাধবীলতার মতো করে ভালোবাসতে হয় তা সে সময়তেই বুঝে নিলাম। এরপর এল জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বই ‘সাতকাহন’। আমি নিজেকে নতুনভাবে জানতে শিখেছি সাতকাহন পড়ে। অবাক হয়ে যেতাম জীবনের কঠিন সত্যতাকে এমন করে দেখে, ভবিষ্যত জীবনে এই অভিজ্ঞতা আমার কত কাজে যে এসেছে আমি জানি! আমি সত্যিই একদিন হয়ে উঠলাম দীপাবলি, ভাগ্যের পরিহাস হোক বা বাস্তবতার খেলা। দীপাবলি আর জয়িতার মতো পরিস্থিতিকে সামলে চলেছি আজ এক যুগের মতো। সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন আমায় ‘আরে তুমিই তো আমার দীপাবলি!’ সত্যিই তো, আমিই তো সেই দীপাবলি, আমি তাই তো জেনে এসেছি। জীবনের মধ্যাহ্নে এসে কখনো হয়ে উঠেছি মাধবীলতা।অনিমেষকে হৃদয়ে ধারণ করেছি,সিঁথিতে নির্বাক ভালোবাসারা খেলে বেড়ায়। সমরেশ মজুমদার- কতখানি জুড়ে থাকা,কতখানি সাহসকে মুঠো ভরে পাওয়া, কতখানি গড়তে শেখানো তা নিজেকে দেখলে বেশ টের পাই। প্রতিটি সংগ্রামী নারীর গল্পই কি একেকজন দীপাবলি কিংবা জয়ীর গল্প নয়? প্রতিটি অব্যক্ত ভালোবাসার গল্পই কি অনিমেষ- মাধবীলতার না!