‘আবেদ ভাই বলতেন ভুল থেকে শিখতে হবে’

52

ফজলে হাসান আবেদের চিরপ্রস্থানে একজন উদ্যোগী মানুষকে হারানোর বেদনাই বাজছে তার গুণমুগ্ধ স্নেহধন্যদের মনে। “যে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে উনি সবসময় উৎসাহ দিতেন। বলতেন, ভুল করে যে শেখে, সেটা উন্নয়ন। ভুল থেকে শিখতে হবে। এই কথাটা উনি অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন,” বলেন শীপা হাফিজা।
ফজলে হাসান আবেদের দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তার সংস্পর্শে এসেছেন অনেকেই, তাদেরই একজন শীপা হাফিজা, যিনি এখন আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। ফজলে হাসান আবেদের হাতে গড়া ব্র্যাকে এক সময় কাজ করেছেন শীপা হাফিজা; সেই সূত্রে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাকে।
শীপা বলেন, “নারী অধিকার, কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা- সবকিছু উনার কাছ থেকে শিখেছি। যখনই উনার কাছে গিয়েছি, তখন খুব জুনিয়র ছিলাম, তখনও দেখেছি সবসময় উনি সামনের মানুষকে প্রাধান্য দিতেন।” খবর বিডিনিউজের
কর্মগুণে যে কজন বাংলাদেশি বিশ্বব্যাপী পরিচিত, তাদের একজন ফজলে হাসান আবেদ ৮৩ বছর বয়সে শুক্রবার ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
শীপা হাফিজা বলেন, স্যার আবেদ নিজেই বলেছেন, তিনি একটি সুখী জীবন কাটিয়েছেন। আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি তার সঙ্গে। আমরা যেটা দেখেছি, তার প্রতিটি চিন্তায় দরিদ্র মানুষের কল্যাণ থাকতো। উনার কাছ থেকে কোনো একটা কাজ নিয়ে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন করতেন- গরিব মানুষের কী লাভ হবে?
দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নাইট উপাধিতে ভূষিত হন আবেদ। ১৯৭২ সালে তার হাত ধরে যাত্রা শুরু করা ব্র্যাক এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও।
শীপা বলেন, এই যে আড়ং বা অন্যান্য যেসব উদ্যোগ সেগুলো উনি কেন করেছিলেন? উনি বলতেন, সবসময় অন্যের পকেটে হাত দিয়ে চলা যাবে না। অনুদান না এলে কী হবে? নিজের পকেটে হাত দিয়ে চলার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদকে ব্র্যাকও স্মরণ করেছে তার উদ্যোগী ভূমিকা এবং নতুন উদ্যোগ নিতে উৎসাহদাতা হিসেবে।
“আমাদের বুকে আত্মবিশ্বাসের বীজ বুনে দিয়েছেন আপনি। আমরা শিখেছি কীভাবে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হয়, শত ব্যর্থতার মাঝেও উঠে দাঁড়াতে হয়, না থেমে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। মানুষের ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে চিনতে শিখেছি আমরা।”
দীর্ঘকালের বন্ধু ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে গভীর শোকাহত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ফজলে হাসান আবেদ মানুষের কল্যাণে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। তার কাজ এবং কথার মধ্যে পার্থক্য ছিল না। তিনি যা কিছু করেছেন, মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে করেছেন। নিজের কথা ভেবে তিনি কিছু করেননি।
ফজলে হাসান আবেদের পরিমিতিবোধের বিষয়টি সবার আগে বলেন বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ফজলে হাসান আবেদ দেশপ্রেমিক এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।
ফজলে হাসান আবেদ তরুণ প্রজন্মকে খুবই পছন্দ করতেন। এখন ব্র্যাকের নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মের হাতে। এই যে তরুণ প্রজন্মের প্রতি আস্থা রাখা, মূল্যায়ন করা, এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। উনি সবার কথা শুনতেন, খুব ভালো শ্রোতা ছিলেন।
রিজওয়ানা বলেন, বাংলাদেশের অনেক এনজিও নেতা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। উনার জন্য এ ধরনের অনেক প্রলোভন ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন, উনার একমাত্র কাজ হচ্ছে ব্র্যাক।
বিদেশি কোম্পানির উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে একাত্তরে লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ফজলে হাসান আবেদের ভূমিকা স্মরণ করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও তাকে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সমর্থনে লন্ডনে তিনি জনমত সংগঠিত করেছিলেন। ওই সময়ে তার দেওয়া সোয়েটার আমি ১০ বছর পরেছি।
আবেদের কর্মময় জীবন স্মরণ করে মেনন বলেন, দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ ও উন্নয়নে তার মডেলের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য তো রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এনজিও সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা, শুধু ঋণ নিয়ে শোষণ করে, তা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন জায়গায় তিনি এনজিওকে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুকে ‘উন্নয়নের কিংবদন্তির’ প্রয়ান হিসেবে দেখছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি এক শোকবার্তায় বলেন, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, সামাজিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ফজলে হাসান আবেদ যে কীর্তি গড়েছেন তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। হতদরিদ্রের উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে ফজলে হাসান আবেদ এর উদ্যোগ অক্ষয় হয়ে থাকবে।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের শোক বার্তায় বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, তৃণমূল মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং গ্রামীণ জনপদে দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচি সামনে রেখে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করে নিরলসভাবে জাতি গঠনে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
“ব্র্যাকের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদের নারীদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংকসহ অসংখ্য মর্যাদাবান প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়ে জাতিকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।”
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে আসেন ফজলে হাসান আবেদ। ভারত প্রত্যাগত এক কোটি শরণার্থীর ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হওয়া সিলেটের সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই অঞ্চলকে কর্মএলাকা হিসেবে বেছে নেন তিনি।
১৯৭২ সালের ১ ফেব্রূয়ারি বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি (ব্র্যাক) প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। সেই ব্র্যাক এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বে বহু সম্মাননায় ভূষিত ফজলে হাসান আবেদ এ বছরই নেদারল্যান্ডসের নাইটহুড ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ’ খেতাবে ভূষিত হন।
ফজলে হাসান আবেদকে হারানোর বেদনা কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতেও তারই শরণ নিচ্ছে ব্র্যাক। “শোক আমাদের স্তব্ধ করেছে, একথা সত্য। কিন্তু পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, সামনে এগিয়ে যাওয়ার দীক্ষা তো আপনিই আমাদের দিয়েছেন।”