আত্মহুতির গল্প

73

 

মেয়েটির গায়ের রঙ ফর্সা। গোলগাল চেহারা। চোখের উপর আলতো করে কাজল টেনে দিলে মাইরি! হাসলে গালের মাঝখানে টোল পড়ে। যে-ই বাড়ি আসে জিজ্ঞাসা করে মেয়ে কিসে পড়ে, ‘বিয়ে দিবি কখন?’ ‘আট ক্লাসে পড়ে মোটে বু। বড় হওক। পইড়া সাইরা মানুষ হওক। হের বাদে বিয়ে শাদির নাম।’ মেয়েটির নাম ফারিয়া। বাড়ি বানিয়াচং। জেলা হবিগঞ্জ। বাবার বড় আদরের মেয়ে। মা ঘরের বিভিন্ন কাজে বকাবকি করে। বাবা বারবার মেয়েকে আগলে রাখে। তার আরো দুইটা ছোট বোন আছে। একটাও ছেলে সন্তান নেই। এ নিয়ে তার বাবার কোনরকম আক্ষেপ নেই। মার মনটা খচখচ করে। ইশ! যদি একটা ছেলে থাকতো । বাবার সাথে কাজে হাত লাগাতে পারত। একা মানুষ আর কত!
বিদ্যাদেবি আদর্শ মহিলা উচ্চ বিদ্যালয়। এখানকার লোকের মুখে মুখে নামটি শোনা যায়। অনেক কৃতি শিক্ষার্থী প্রসবিনী এ বিদ্যালয়টি। ফারিয়া এই স্কুলে পড়ে। অনেক কষ্টে সুযোগ মিলেছে। আগেও বেশ কয়বার পরিক্ষা দিয়েছে। টিকতে পারেনি। সপ্তম শ্রেণিতে ওয়েটিং লিস্টে ছিল। ডাক পড়েনি। পরে ও যখন মদনমোহনে ভর্তি হয়ে যায় । তখন এখান থেকে ডাক আসে। আর বাড়তি খরচের জ¦ালায় ভর্তি হয়নি। এবারে সোজা সুযোগ পেয়েছে। মামা লন্ডন প্রবাসি। বোনের প্রতি খুব ভক্তি। সবার বড় বোন ফারিয়ার আম্মু। ছোট বেলায় তাদের অনেক কষ্টের সংসার ছিল। অল্প বয়সে মা মারা যায়। তারপরে বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। সৎ মায়ের নানান রকম নির্যাতনে বোনই ভাইদের ছোট বোনদের আগলে রাখেন। তাই তারা ফারিয়ার মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। বোনের মেয়েদের পড়াশোনার খরচ তারাই চালান। ঈদে জামা-কাপড়ের টাকা। বড় কোন সমস্যায় তারাই এগিয়ে আসে সর্বাগ্রে।
শাহেদ মামা যখন জানলেন ভাগনি বড় স্কুলে সুযোগ পেয়েছে খুবই উচ্ছ¦সিত হলেন। তার চোখে আড়ালে জল এলো। বড় আপাও এ স্কুলে পড়ত। খুব ভালো ছাত্রী ছিল। আম্মার খুব প্রিয় ছিল ও। আম্মা বলতেন বড় আপা ডাক্তার হবে। মায়ের চিকিৎসা করবে। মা তখনি সেড়ে উঠবেন। ফারিয়ার নানুর প্যারালাইজড ছিল। সারাদিন স্কুল করে এসে ওর মা-ই ঘরের সব কাজ করতো। এ নিয়ে তার কোন আক্ষেপ ছিল না। তবে মা মারা যাবার পর গল্প পাল্টে যায়। বাপ হয়ে যায় তালই। ভাইদের বুকে আগলে রাখে বু। তাই বু-কে ভাইরা আজো এতো ভালবাসে। মায়ের আসনে বসিয়েছে। দেশে আসলে দৌড়ে আগে বু-র কাছে আসে।
এ বছরের মতন বৈশাখ খুব কম দেখেছি। ঝড়-বৃষ্টির দেখা নেই। কি ভ্যাপসা গরম রে বাবা। ছেলে-বুড়ো সকলের-ই নাজুক অবস্থা। লকডাউনের দ্বিতীয় দফা চলছে। গত বছর মার্চ মাসে যে স্কুল কলেজ বন্ধ হলো আর খোলার নাম নেই। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকাংশ ঝরে পড়েছে। এমনিতে গরীব দেশ। কোন রকম দিন এনে দিন খাবার লোকের সংখ্যায় অধিক। তাও দাঁতে দাঁত কামড়ে অনেকে ছেলে-মেয়েদের বিদ্যে শিক্ষা দিতে আগ্রহী। উন্নয়নশীল দেশের জনগণ যেমন হয় আর কি। দুইটা বছর পড়াশোনা বন্ধ। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে ঢাকায়। দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। শিক্ষা মন্ত্রীর নড়চড় নেই। মনে হয় না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহসা খুলবে। আরো বছর খানেক লাগতে পারে। তারও বেশি লাগতে পারে। সকল শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় এনে তবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাবছে সরকার। এ জাতীয় ডায়ালগ মন্ত্রী আমলাদের মুখে মুখে। গরীবের ঘরে চলছে হাহাকার। করোনায় গরীব হয়েছে আরো গরীব। মধ্যবিত্ত হয়েছে উচ্চবিত্ত। উচ্চবিত্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত। যে লোকের ঘরে একটি ছেলে নেই। তিন তিনটা মেয়ে। তার মাথা ভর্তি চিন্তা থাকা স্বাভাবিক। ফারিয়ার বাবাকে দেখে কারুর সেটা মনে হয় না। তার চালন চলনে কারুর কিছু বুঝবার সাধ্য নেই। আয়রন করা শার্ট সে বাল্যকাল থেকেই পড়ে। এখনো পড়ে। মাথায় দু-পাশে সিতি কাটে। পায়ে মাস্টার স্যান্ডেল। এটার নাম স্যান্ডেল হলেও এটা আসলে জুতা। মানুষ কেনো তাকে স্যান্ডেল বলে কে জানে। স্যান্ডেলের মতন ফিতে তাই কি!
সন্ধ্যা বেলা বাড়ি ফিরছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। সাদা বকগুলো উড়ে যাচ্ছে দল বেধেঁ। আপন ঠিকানায়। গরমে কাবু হোসেন দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো এক জুড়ো জুতো পায়ে। মাথায় পাঁচ প্যাচের টুপি। নামাজের বেলায় খুবই উদাসিন। কিন্তু কুরআন-হাদিসের পন্ডিত। পরনের পাঞ্জাবিটায় জায়গায় জায়গায় তালি মারা। জ্ঞানি মানুষ। তবে মাথায় টুপি দিয়ে ঘুরলেও ধর্ম চর্চায় ভীষণ অমনোযোগি। কেউ কেউ বলে ভান্ডারি। কেউ বলে নাস্তিক। কেউ বলে না সে চরমোনাই। কেউ বলে ইমাম হায়াত। কেউ বলে রাজারবাগি। আরেকজন বলে না সে দেওয়ানবাগি। তা সে যে বাগি হোক। মানুষটা খুবই সহজ সরল। মাস্টারি করতো। এখন যেহতু স্কুল-কলেজ বন্ধ । সারাক্ষণ বাড়িতে শুয়ে-বসে কাটায়। হঠাৎ সে একদিন ফারিয়ার বাবাকে ধরে পথে। বাইসাব স্কুল তো বন্ধ অনেক দিন। ‘মাইয়ারার পড়ার খবর কিতা! ’ ‘আর কইওনা ভাই শেষ। আমরা গরীব মানুষ। ছেলে হইলে কাজে দিয়া দিতাম। মাইয়া বাড়িত বইয়া কাটায়। ’ ‘আমিও তো সেম অবস্থা। আমি যদি তারারে চাচার মতন পড়ায় আপত্তি আছে!’ ‘না না নারে বো কিতা মাতো ইতা। পড়াও। খুবই ভাল কথা। ফারিয়ার মারে আমি কইমু। ’
২.
সোমবার। সন্ধ্যে বেলা। ফারিয়ার মা-বাবা ডাক্তারের কাছে। ফারিয়া পড়তে বসেছে। গণিতের ঝোঁক তার। সময় পেলেই অংক কষে। মায়ের ডাক্তার হবার ইচ্ছে মেয়ে পূরণ করবে। এটাই তার স্বপ্ন। কিছুক্ষণ পর দরজায় টকটক শব্দ। স্যার এসেছে। এসে পড়াতে লাগলো। মুনাফা-আসলের অংক কিভাবে করতে হয় তা বুঝাচ্ছিলেন। ফারিয়া মনোযোগ দিয়ে গণিত করে যাচ্ছে। হঠাৎ চোখ তুলে দেখে স্যার তার দিকে চেয়ে আছে একনিষ্ঠভাবে। ওর কেমন জানি একটু অস্বস্তি লাগে। তারপরেও মাথা নামিয়ে আবার গণিতে মন দেয়। স্যার তাকে পিঠে হাত দিয়ে অংক বুঝানোর চেষ্টা করে। ও সরে আসে। স্যার যেনো ওর অস্বস্তিবোধ বুঝেও বুঝে না। এমনভাবে সময় কাটলো কিছুক্ষণ। ওর মা-বাবা ফিরে আসে। রাতে ঘুমিয়ে কি যেনো দুঃস্বপ্ন দেখে ও। শরীরে ভীষণ জ্বর আসে। খানিক পর পর চমকে উঠে। মাকে জড়িয়ে ধরে। পরদিনও একই অবস্থা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। সব দেখেশুনে ডাক্তার জানালো কোন কারণে ও ভয় পেয়েছে। কয়েকটা ওষুধ দিচ্ছি রাতে খাইয়ে দেবেন। ঠিক হয়ে যাবে। রাতে ওর সারা শরীর কেঁপে কেঁপে জ্বর আসে। স্যার বোধহয় সব জেনে কিছুটা শংকিত হয়ে পড়েন। ওর বাবার কাছে জিজ্ঞেস করার সাহসও করছিলেন না। আস্তে আস্তে ও সুস্থ হয়ে উঠে। আবার স্যার আসে। ও পড়াশোনা করে। দেখতে দেখতে স্কুল একদিন খুলে দেওয়া হলো। শিক্ষার্থীরা যেনো প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে। ফারিয়ার মনে ভীষণ আনন্দ। সারাদিন বাসায় বসে বসে ও যে ক্লান্ত। নবম শ্রেণিতে তুলে দেওয়া হয় ওদের। অটো প্রমোশন। করোনার কারণে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব ছিল না। ও এবার আরো বেশি আনন্দিত। ও যে আস্তে আস্তে মায়ের স্বপ্নের কাছে পৌঁছাচ্ছে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে ও। মামা শুনে খুবই খুশি হলেন। বললেন কি চাও মা বলো। বললো একটা ভালো মোবাইল ফোন। মামা বললেন ঠিক আছে। আগামী মাসে হবিগঞ্জের এক লোক দেশে যাবে। তাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। যথাসময়ে ফারিয়ার হাতে এসে ফোন পৌঁছায়। ফারিয়া কি যে খুশি আহা!
ফোনে কতকত ছবি তুলে। কত রকম করে। বান্ধবিদের কাছে ওর কদর বেড়ে গেলো। ও একটা ফেসবুক আইডি থুললো। টিকটক অ্যাপ ডাউনলোড করলো। টিকটকের রমরামা ভিডিয়ো। ওকে খুব সহজে আকর্ষণ করে। নানান কায়দায় ও ভিডিয়ো বানাতে লাগলো। সেখানে লাইক-কমেন্টের ছড়াছড়ি। রাতারাতি সেলিব্রেটি হওয়ার ভ’ত ঢুকে ওর মাথায়। আস্তে আস্তে ও পড়াশোনা থেকে দূরে যেতে থাকে। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ। বাবার মাথায় টেনশন চাপে। আবার ওর পুরনো স্যারকে রাখা হলো ওকে পড়াতে। বাবার মাথায় এলো স্যার ছাড়া পড়ার কারণে সম্ভবত ওর ফলাফল বিপর্যয়। স্যার ওকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ওর হাত ধরে। পিঠে হাত বুলায়। মাথায় হাত বুলায়। আগের মতন ওরও অস্বস্তি লাগে না। ওর যেনো ভালো লাগে। এভাবে হতে হতে ক্লাস টেনে উঠে ও। আস্তে আস্তে স্যারের সাথে প্রেমে জড়ায় সে। নানা বাড়িতে নানার একটা বোন মারা যায়। মা-বাবা সেখানে যায়। এই ফাঁকে স্যার ওকে পড়াতে আসে। একা পেয়ে দুজনের সম্মতিতে মিলিত হয়। ক্লাস টেনের পরীক্ষা সামনে এমন সময় ওর গায়ে আবার প্রচন্ড জ্বর। ও বুঝতে পারে ওর এবারের জ্বর অন্য কারণে। ও স্যারকে জানায়। স্যার সব শুনে ভয়ে ওর সাথে যোগাযোগ থামিয়ে দেয়। ও কিভাবে বাবা-মাকে মুখ দেখাবে। স্যারকে ও টেক্সট করে ও স্যারের সাথে কোথাও পালিয়ে যেতে যায়। স্যারের যে পরিবার আছে। বাচ্চাকাচ্চা আছে। সে ভয়ে ও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফারিয়ার সামনে কোন পথ খোলা নেই। অনেক ভেবে সে ২২শে মার্চ রাতের অন্ধকারে ওড়নায় গলা পেচিঁয়ে আত্মহত্যা করে। কেউ বুঝতে পারে না কি হয়েছে। ওর বাবা-মা আঁচ করতে পারলেও লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খুলেনি।