আত্মসমর্পণকারীদের অনেকেই ফের ইয়াবার কারবারে কয়েকজন আবার স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনপ্রতিনিধিও বনে গেছেন

17

বেশ ঘটা করেই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রতিশ্রæতি দিয়ে সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তালিকাভুক্ত একশ’ দুই জন ইয়াবা কারবারি। কিন্তু বিগত প্রায় দু’বছরে তাদের অনেকেই জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে ফের ইয়াবার কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে আত্মসমর্পণকারীদের অধিকাংশই জামিনে মুক্তি লাভ করেছেন। তবে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি তালিকাভুক্ত একশ’ দুই জন ইয়াবা কারবারির আলোচিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কয়েক মাস যেতেই একে একে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন ইয়াবা কারবারিরা। গত প্রায় দু’বছরে আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিদের সিংহভাগই কারামুক্তি লাভ করেছেন। আর এর মধ্যে কক্সবাজার সদর এবং টেকনাফ-উখিয়ায় পৌর ও ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের অনেকেই সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনপ্রতিনিধিও বনে গেছেন। এখনও তারা আড়ালে থেকে এলাকায় ইয়াবার কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। যে কারণে সরকারঘোষিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী সর্বাত্মক যুদ্ধের পরও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার কারবার কার্যতঃ বন্ধ করা যায় নি। বরঞ্চ একই রুট দিয়ে সদ্যবিদায়ী বছরে স্বর্ণ ও শতভাগ মেথাম্ফিটামিনযুক্ত ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের চালানও দেশে নিয়ে আসা হয়েছে। আইসের ঢেউ ধীরে ধীরে বিত্তশালী মাদকসেবী হয়ে আছড়ে পড়ছে সারা দেশে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিরা জামিনে বেরিয়ে এসে আগের রূপেই ফিরে গেছে। তাদের বেশিরভাগই ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েছে।
আত্মসমর্পণের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে টেকনাফ-উখিয়ার সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির ছোট ভাই টেকনাফের আলিয়াবাদের আবদুস শুক্কুর, একই এলাকার আমিনুর রহমান, পশ্চিম লেদা এলাকার নুরুল হুদা মেম্বার, উত্তর লেঙ্গুর বিলের দিদার মিয়া, মুন্ডার ডেইলের শাহেদ রহমান নিপু, মধ্য জালিয়াপাড়ার মোজাম্মেল হক, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার জোবায়ের হোসেন, কুলালপাড়ার নুরুল বশর, সাবেক কাউন্সিলর নুরশাদ, শিলবুনিয়াপাড়ার কামরুল হাসান, ডেইলপাড়ার আবদুল আমিন, একই এলাকার নুরুল আমিন, চৌধুরীপাড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, ফয়সাল রহমান, নাজিরপাড়ার এনামুল হক ওরফে এনাম মেম্বার, মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন, নাজিরপাড়ার সৈয়দ হোসেন, আলীর ডেইল এলাকার শাহেদ কামাল, সাবরাংয়ের মৌলভী বশির আহম্মদ, পুরাতন কল্যাণপাড়ার শাহ আলম, নাজিরপাড়ার আবদুর রহমান প্রমুখ রয়েছেন। বর্তমানে তারা প্রকাশ্যে এলাকায় অবস্থান করে পরোক্ষভাবে ইয়াবার কারবারে কলকাঠি নাড়ছেন। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়ের তালিকায় যে ৭৩ জন ইয়াবা গডফাদারের নাম ছিল, তাদের মধ্যে মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ১২ জন। এর বাইরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ২৫ জন। এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে ৩৫ গডফাদার। অভিযোগ উঠেছে, তালিকাভুক্ত ইয়াবার গডফাদারদের ধরতে এখন আর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তেমন আগ্রহ নেই। তাই আত্মগোপনে যাওয়া গডফাদারদের কেউ কেউ ফিরে এসে বর্তমানে প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরেও বেড়াচ্ছে।
এলাকাবাসী বলছেন, বর্তমানে মিয়ানমার ও টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তের যেসব পয়েন্ট দিয়ে দেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসা হচ্ছে, তাম মধ্যে বড় ডেইল, উখিয়ার ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, মিস্ত্রিপাড়া, জেটিঘাট, জালিয়াপাড়া, নোয়াপাড়া, সাবরাং, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়া, কায়ুকখালী পাড়াঘাট, নাইট্যং পাড়াঘাট, বরইতলী, কেরুনতলী, হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা, জাদিমুড়া, আলী ডেইল, দমদমিয়া, চৌধুরীপাড়া, মৌলভীবাজার, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী, কাঞ্জরপাড়া, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, শাহপরীর দ্বীপ, নাফ নদীর খুরের মুখ, ঘোলারপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মাঝেরপাড়া সৈকত, কচুবনিয়া, হারিয়াখালী, কাটাবনিয়া, মুন্ডার ডেইল, মহেশখালীয়াপাড়া সৈকত, নোয়াখালীপাড়া, খোনকারপাড়া, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর, শীলখালী, মাথাভাঙ্গা, উখিয়ার থাইংখালী, পালংখালী, বালুখালী, ঘুমধুম, রেজুপাড়া, তমব্রæ, আছাড়তলী ও ঢালারমুখ অন্যতম।
জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে গোয়েন্দা ইউনিটগুলো এরইমধ্যে কক্সবাজার জেলায় বিশেষ অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তাদের অনুসন্ধানে নতুন কারবারির পাশাপাশি আত্মসমর্পণকারীদের অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় মাদক কারবারে জড়িয়েছে বলেও তথ্য মিলেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বদেশকে বলেন, আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে যারা জামিনে মুক্ত হয়েছে তারা সকলেই স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয়-স্বজন। তারা ফের ইয়াবা কারবার চালাচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। স¤প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে মাদক কারবারিদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকও হয়েছে। ওই বৈঠকে কক্সবাজার-টেকনাফ সীমান্তে মাদকের কারবার নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে যারা জামিনে বের হয়েছে, তাদের গতিবিধির ওপর আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। পুরোনো কারবারিদের শূন্যতায় নতুন করে যেসব ব্যক্তি ইয়াবার কারবারে সক্রিয় হয়েছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে যাতে ইয়াবাসহ কোনও ধরনের মাদকের চালান দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সীমান্তরক্ষীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটসহ সকল পর্যায়ে নজরদারি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত পলাতক ইয়াবার কারবারিদের ধরার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। জামিনে এসে কেউ যদি ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।