‘আতংকিত হয়ে নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখুন হিজড়াদের’

5

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী

ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ এই শব্দগুলো বলে দেয় এটি লিঙ্গ পরিচয় এর সাথে সম্পর্কিত, সাহিত্যে তাদের বলা হয় বৃহন্নলা। অনেকেই এই তৃতীয় লিঙ্গকে রূপান্তরকারী হিসেবে বলে থাকেন। রূপান্তরকারী বলার কারণ হচ্ছে এদের শারীরীক গঠন এবং মানসিক মনোবৃত্তির মধ্যে বিপরীতমুখী একটা সম্পর্ক থাকে। আমাদের দেশে তৃতীয় এবং সমকামী এই দু’টি বিষয়কে অনেক সময় এক করে দেখা হয় প্রকৃত অর্থে সমকামীদের সমস্যা লিঙ্গ পরিচয়ে নয়, তাদের বৈশিষ্ট হচ্ছে যৌন মানসিকতার বা বিকৃত যৌনতা বিষয়ে। আর তৃতীয় লিঙ্গ হচ্ছে তার শারীরিক গঠন এবং এর মানসিক প্রবৃত্তির বা আচরণ নিয়ে লিঙ্গ পরিচয় এর জন্য। আমরা সকলে জন্মের পর থেকে একটি জন্ম পরিচয় নিয়ে বড় হয়ে উঠি-জন্মের পরেই অভিভাবক জানিয়ে দেওয়া হয় আপনার একটি পুত্র সন্তান বা কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। কিন্তু জন্মের পরে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে অনেকের শারীরিক এবং মানসিক প্রবৃত্তির ও স্বভাবে ভিন্ন ধরনের রূপ প্রকাশ পায় তখনই আমরা ধরে নেই এই সন্তানটি তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী আমাদের সহজ বাংলায় হিজড়া। শারীরিক নানা ত্রুটি নিয়ে মানুষের জন্ম হয়। লিঙ্গ ত্রুটিও একটি রোগ। এ রোগের কারণে যদি তাকে বর্জন করা হয়, তার মূল লিঙ্গ স্বীকার করা না হয়, তাহলে তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে।
তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের পর থেকে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে তাকে হেয় প্রতিপন্ন হতে দেখা যায়, হিজড়া সন্তান জন্ম নিলে পিতা-মাতা সমাজ বাস্তবতার কারণে লজ্জাবোধ করেন, এখানেই তারা প্রথম অবহেলিত হয়। সন্তান হিজড়া হওয়া লজ্জার কিছু নয়, কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রে দেখা যায় তৃতীয় লিঙ্গের ভাব পরিলক্ষিত হলেই অভিভাবকগন তাদের সাথে নেতিবাচক আচরন করেন, ফলশ্রুতিতে মানসিক চাপের কারনে দেখা যায় একদিন সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পরিবার থেকে এবং এরপর বাধ্য হয়ে হিজড়া দলে যোগ দিয়ে সমাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর সে পুরোপুরি হিজড়া সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং তাদের নিয়ন্ত্রন যিনি করেন তিনি হলেন তাদের ‘গুরুমা’ যার কথায় বাইরে কোন অবস্থাতেই যাওয়া যায় না এবং গুরুমার নির্দেশনা মত সে পরিচালিত হয়।
২০১৩ সালের নভেম্বরে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ২০১৩ সালে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও পাসপোর্ট বা পরিচয় পত্রের ক্ষেত্রে হিজড়াদের নারী বা পুরুষ হিসেবে লিঙ্গ বেছে নিতে হতো। ২০১৯ সালে ১১ই এপ্রিল ভোটার ফরম সংশোধন করে পুরুষ মহিলার এর পাশাপাশি ‘হিজড়া’ অন্তর্ভুক্ত করা হয় না হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ মতে হিজড়াদের সংখ্যা ১২,০০০ এর অধিক। অন্য একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপমতে এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
আচার আচরণগত কারণে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আমাদের সমাজে ভিন্ন চোখে দেখে আমাদের দেশে তাদের অবস্থান যেন দলিত বা হরিজন সম্প্রদায়েরও নিচে। পেশাজীবী হিসেবে তাদের কেউ গ্রহন করে না। তাই বেঁচে থাকার তাগিদে তারা ভিন্ন পেশায় জড়িত হয় যেটি অনেকটা ভিক্ষাবৃত্তি। নাচ গান দৈহিক অংগ ভংগীর মাধ্যমে তারা মানুষদের কাছ থেকে সহায়তা বা অর্থ আদায় করে। যেখানে হিজড়াদের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার সেখানে বর্তমান সময়ে হিজড়া মানে আমাদের সমাজে এক আতংকের নাম। কেন তাদের দেখলে মানুষ আতংকিত হয় বা এড়িয়ে চলে তারও কিছু কারণ আছে। বর্তমান সময়ে হিজড়া সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যে এখন শুধু বেঁচে থাকা বিষয় নয়, তারাও এখন অর্থশালী, বিত্তশালী হতে চায় তাই তাদের নিয়ন্ত্রণকারী ‘গুরুমা’ এর ইশারায় তারা মানুষের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে অর্থ আদায় করার চেষ্টা করছে। এখন তারা যত্রতত্র জোর খাটিয়ে অর্থ আদায় করে এমনকি তাদের দাবীকৃত অর্থ প্রদানে অনেকটা বাধ্য করে। বাস ষ্টেশন, ট্রাফিক সিগন্যাল, দোকানপাট বা বিয়ে বাড়ী নয় এখন তারা মাসিক ভিত্তিতে ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাদাঁ আদায় করে। এমনও শোনা যায় অনেক অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান অর্থ আদায়ে প্রেসার গ্রæপ হিসেবে হিজড়াদের কন্ট্রাক্ট এর মাধ্যমে ব্যবহার করে। চাঁদা প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করলে অশালীন আচরণ, শরীর অনাবৃত করে তারা এমন অঙ্গভঙ্গি করে যাতে অনেকেই লাজ-লজ্জার ভয়ে সে দাবীকৃত অর্থ প্রদানে বাধ্য হন। এ বিষয়ে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হলে পুলিশও তেমন পাত্তা দেয় না অথবা বলে “ভাই কিছু দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন”। কারন এই হিজড়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে অনেক সময় পুলিশও হেনস্থা হয় তেমনি তারা সংবদ্ধ হয়ে থানাও ঘেরাও করে। তাদের এই মনোভাবের জন্য শুধু তারা একাই দায়ী নয়, আমাদের সমাজের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও এর জন্য দায়ী কারণ অনেকেই তাদের এলাকায় বসবাসকারী হিজড়াদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় করেন নয়তো এলাকা থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি প্রদান করে।
আমাদের সমাজে অন্যান্যদের মতো হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকার মাধ্যমে বেচেঁ থাকুক সেটাই আমাদের কাম্য। তাদের নিয়ে আমাদের নেতিবাচক যে মনোভাব তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সবারই এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমত হিজড়া সম্প্রদায়কে নিজেদেরই মানুষের কাছে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে তাদের নিয়ে মানুষের যে ভয়ার্ত অভিজ্ঞতা তা তাদের আচার আচরণের সংশোধনের মাধ্যমে বুঝাতে হবে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে অনেক কিছুই করতে হয় কিন্তু সেটা ইতিবাচক হলে মানুষও সেটি মানবিক মনোভাব নিয়ে দেখে। যারা হিজড়া সম্প্রদায়ের, তাদেরও নিজেদের উন্নতি নিয়ে চিন্তা করা উচিত। নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করা। এর জন্য কাজ শেখা। যেকোনো বৈধ পেশায় সম্পৃক্ত হওয়া। মানুষের কাছে হাত পেতে জীবিকা নির্বাহ করা ভালো কোনো কাজ নয়, সমাজের অন্যান্য পেশাজীবী অংশে তাদের সম্পৃক্ত করার জন্য আমাদের সবার মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে ।
মানুষ হিসাবে একজন হিজড়াকে ঘৃণার চোখে দেখা, তুচ্ছ ভাবার কোনো অবকাশ নেই। হিজড়া হওয়ার পেছনে তার কোনো হাত নেই, এটি একটি রোগ; হরমোনজনিত সমস্যা। সামাজিক বৈষম্যের কারনে হিজড়া জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষার অভাব ও অদক্ষতার কারনে হিজড়া জনগোষ্ঠী তাদের যে সক্ষমতা রয়েছে তা পূর্ণ সদ্বব্যবহার করতে পারছে না, তাই তারা মানব সম্পদ হিসেবে রূপান্তরিত না হয়ে সমাজের বোঝা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে অবহেলা না করে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের পাশে থেকে কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরী করে দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর ও কিছু কিছু এনজিও হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকার মানোন্নয়নে কাজ করলেও তা খুব বেশী ফলপ্রসূ নয়। কিন্তু তাতে হিজড়াদের জীবনমানের খুব একটা উন্নতি হয়নি। তারা সেই আগের মতোই অবহেলিত জীবনযাপন করছে। হিজড়াদের রয়েছে মানবিক প্রবৃত্তি, তারাও মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো রাজধানী ঢাকার প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ার পর হিজড়া জনগোষ্ঠীর পক্ষে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রদান করা হয় বিশ লক্ষ টাকা। এমনকি বিভিন্ন বন্যা দুর্যোগে বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করতে আমরা দেখেছি।
মানবিক মনোভাব নিয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে এই সমাজে সকলের মতো বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্র এবং আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। প্রথম করণীয়, হিজড়াদের নিয়ে একটি ডেটাবেইস তৈরী করা এরপর চিহ্নিত করতে হবে, কারা আসল হিজড়া আর কারা কৃত্রিম। বর্তমানে আসল তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়ার পাশাপাশি কিছু কৃত্রিম হিজড়াও সৃষ্টি হয়েছে। কৃত্রিম হিজড়াদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। মানবিক মনোবৃত্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার মানসে নয় আর্থিক এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন। বাস্তবে যারা জন্মগত হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী তাদের জন্য আলাদাভাবে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসস্থল ও কর্মসংস্থান তৈরী করা গেলে একসময় তারা দেশের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে। কোনো হিজড়া সন্তান যদি তার পিতামাতা ও সমাজের দ্বারা বৈষম্যের শিকার না হয়, বরং উপযুক্ত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে তাদের সঠিক আনুকূল্য লাভ করে, তবে উন্নত মন-মানসিকতা আপনিই তার মধ্যে গড়ে উঠবে। তার ভেতর হীনম্মন্যতা দানা বাঁধার অবকাশ হবে না। মানুষ যেন তাদের সহজে চাকরি দিতে পারে প্রয়োজনে যারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিভিন্ন কর্মসংস্থান করবে তাদের জন্য বিশেষ প্রনোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। আরও নানা সরকারি সুবিধা থাকতে পারে। এভাবে সবাই যদি দায়িত্ব নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই, তারা সংশোধন হতে আগ্রহী হয়, তাহলে যৌথ প্রচেষ্টায় হিজড়া সম্প্রদায়কে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসা সহজ হবে। সুতরাং হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নয়, তাদের নিজস্ব লিঙ্গ হিসেবেই পরিচয় দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে। হিজড়াদের অনেকেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তাদেরকে সমাজে গ্রহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে সাধারন শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীকে কর্মময় করতে হবে। হিজড়ারা যাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে এই রূপ আতংকময় শ্রম বাজারে প্রবেশ করেছে সে সে পথগুলো নিশ্চিত করে ব্যপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। হিজড়ারা প্রায় অন্যদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে থাকে এবং বিকৃত যৌন রুচির কিছু মান দ্বারা যৌন নির্যাতিত হয় প্রয়োজনে আইন করে কেউ যাতে তাদের সাথে খারাপ আচরন না করে তা চিহ্নিত করতে হবে। অপরাধমূলক কাজে হিজড়াদের যারা নিয়োগ করে সে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যে সকল হিজড়ারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এমনকি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা যেন তার পরিবার থেকে অবহেলিত না হয় তার জন্য অভিভাবকদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ