অশনির গতিপথ নিয়ে অনিশ্চয়তা

17

পূর্বদেশ ডেস্ক

ঘূর্ণিঝড় অশনি দুর্বল হতে শুরু করলেও গতিপথ বদলে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখেছে আবহাওয়াবিদদের। আবহাওয়াবিদরা গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ধারণা করছিলেন, এ ঝড় উপকূলে আঘাত না হেনে বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে সাগরেই শেষ হয়ে যেতে পারে। তবে এরপর গতিপথ খানিকটা পাল্টে এই ঘূর্ণিবায়ুর চক্র উত্তরপূর্বে অন্ধ্র উপকূলের কাকিনাদা ও বিশাখাপত্তমের মাঝামাঝি এলাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
জানা গেছে, অশনি এখন পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগরের যে এলাকার দিকে যাচ্ছে, আবহাওয়াবিদরা ওই এলাকাকে বলেন ‘কোন অব আনসার্টেনিটি’। অর্থাৎ, কোন আকৃতির ওই এলাকা থেকে ঘূর্ণিঝড় কোন দিকে যাবে, তা আগেভাগে বলা কঠিন।
জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার মঙ্গলবার দুপুরে অশনির যে সম্ভাব্য গতিপথ দেখিয়েছিল, তাতে ঝড়টি অন্ধ্র আর ওড়িশা উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে বাঁক নিয়ে উত্তর-পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উপকূলের দক্ষিণ দিকে এগিয়ে দুর্বল হতে হতে সাগরেই হারিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে যে সম্ভাব্য গতিপথ জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার দেখিয়েছে, তাতে বুধবার সকাল নাগাদ আসানির অন্ধ্র উপকূল অতিক্রম করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে উপকূল অতিক্রম করার পর বিশাখাপত্তমের কাছ দিয়ে আবার এ ঝড় নিম্নচাপ আকারে সাগরের দিকে বেরিয়ে আসতে পারে।
যে দিকেই যাক, অশনির প্রভাবে ইতোমধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে। সাগর বিক্ষুব্ধ থাকায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস।
পূর্বদেশের কক্সবাজার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, অশনির প্রভাবে বঙ্গোপসাগর এখন উত্তাল। কক্সবাজার জেলায় গত দু’দিন ধরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে বয়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়া। এ অবস্থায় কক্সবাজারের সব মাছ ধরার ট্রলারকে উপক‚লের কাছাকাছি নিরাপদ অবস্থানে থাকার কথা বলেছে আবহাওয়া অফিস। ঈদের ছুটির পরও কক্সবাজারে প্রচুর পর্যটক অবস্থান করছে। সৈকতে আসা পর্যটকদের উত্তাল সমুদ্রে গোসল না করতে বিভিন্ন সতর্কবার্তা দিয়ে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন। এরমধ্যেও অনেক পর্যটক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সাগরে গোসল করতে নামছে। পর্যটকদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সৈকতের লাইফ গার্ড কর্মীরা। কক্সবাজারে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের শহীদ এটিএম জাফর আলম সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলার ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। এছাড়া সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক টিম, রেডক্রিসেন্ট, স্কাউট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তৎপর রাখা হয়েছে।
সভায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার, সুপেয় পানি মজুদ রাখা, উপকূলীয় এলাকার মানুষদেরকে নিরাপদ স্থানে আনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পূর্বপ্রস্তুতিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান বলেন, এই মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড় অশনির কারণে কক্সবাজারে কোন বিপদের শঙ্কা নেই। এরপরও জেলা প্রশাসন সবাইকে নিয়ে একটি সমন্বয় সভা করেছে। সভায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারে সবমিলিয়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার পর্যটক অবস্থান করছেন। পর্যটকরা যাতে সমুদ্রে নেমে গোসল না করেন সে বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে।
ট্যুরিস্ট কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিম রেজা বলেন, কক্সবাজারে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত ঘোষণার পর ট্যুরিস্ট পুলিশ তৎপরতা বাড়িয়েছে। যাতে পর্যটকরা গভীর পানিতে নেমে গোসল কিংবা ওয়াটার বাইক না চালান। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।
জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, জেলায় কোনো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ বলা যাবে না। কক্সবাজার সদর, চকরিয়া ও পেককুয়াসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো মেরামত করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো পরিদর্শন করা হচ্ছে। বর্ষায় যে অংশ দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে সে সব অংশ মেরামতের জন্য আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, অশনির প্রভাবে আগামী তিনদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের স্থলভাগ থেকে এখনও এটি এক হাজার কিলোমিটার দূরে রয়েছে। এর অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে গত সোমবার (৯ মে) থেকে সারাদেশে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গত সোমবারের মত গতকালও দেশের উপক‚লীয় তিন বিভাগে (খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম) অতিভারী বৃষ্টির সতর্কবার্তা জারি করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। উপক‚লীয় এই তিন বিভাগে আগামী তিনদিন ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা রয়েছে। মঝেমধ্যে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। বিকাল ৩টার পর থেকে মেঘের আনাগোনা বেড়ে যায়।
গতকাল মঙ্গলবার আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় অশনির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী (২৩ থেকে ৪৩ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটার বা এর বেশি) বর্ষণ হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।’
বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব ধরনের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপক‚লের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় অশনি’র প্রভাবে নগরবাসীর জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন দামপাড়া কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোন নম্বর ০৩১-৬৩০৭৩৯ এবং ০৩১-৬৩৩৬৪৯।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস জানায়, সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরের সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। তাদের গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সার্বক্ষণিক রেড ক্রিসেন্ট, স্বেচ্ছাসবক, চসিকের আরবান ভলান্টিয়ার টিম ও কর্মকর্তা-কর্মচারী জরুরি সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া শুকনো খাবার, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি মজুদ রাখা হয়েছে।