অরক্ষিত পাহাড়তলী বধ্যভূমি অসম্পূর্ণ শহীদ মিনার

43

তুষার দেব

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ সত্বেও একাত্তরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ বাঙালিদের নৃশংস হত্যাকান্ডের স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের গরজবোধ করছে না কেউই। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও বধ্যভূমি সংরক্ষণে এমন অনীহা বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণের মানুষের মধ্যে নিদারুণ অস্বস্তি তৈরি করেছে। অপরদিকে, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া পুরনো শহীদ মিনার ভেঙে নতুন শহীদ মিনার ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি গণপূর্ত বিভাগ। ফলে এবারের বিজয় দিবসেও অস্থায়ী শহীদ মিনারেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতিতে নাগরিকদের শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, আদালতের নির্দেশনার পরও কেবলমাত্র প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাবে পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসক চাইলে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর একাধিক ডিসি চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কেউই বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়ার গরজবোধ করেন নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে এমন অনীহা কাম্য নয়।
জানা গেছে, বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়তলীর জাকির হোসেন রোডে পৌনে দুই একর ভূমিতে অবস্থিত বধ্যভূমি সংরক্ষণে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করে ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়েছিল। পরে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীনর চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি বাতিল করে টাকা ফিরিয়ে নেয়। আর তখন জমিটি কিনে নেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি) কতৃর্পক্ষ। জমি কেনার পর ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু করে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিন, মিলি রহমানসহ আট বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট রিটটি নিষ্পত্তি করে দিলে আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগ ওই জমিতে বধ্যভূমি রয়েছে কি না, তা জানতে একটি কমিটি গঠন করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লার নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের আদেশ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো ডিসিই এই বধ্যভূমি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর। বর্তমানে বধ্যভূমি এলাকায় একটা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সেটিও ধুলায় ধুসর ও মলিন হয়ে আছে। ঘাস, আগাছা, ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে চারপাশ। মূল বধ্যভূমি যেখানে, সেখানে ইউএসটিসির ইস্পাতের তৈরি একটি অর্ধনির্মিত ভবন দাঁড়িয়ে আছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এই বধ্যভূমিতে অন্তত পাঁচ হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। একাত্তরের ১০ নভেম্বর প্রয়াত অধ্যাপক ড. গাজী সালেহউদ্দিনের বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা আলী করিমসহ একই পরিবারের চারজনকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছিল। একই দিন পাঁচ হাজার নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে এখানে জবাই করা হয়েছিল বলে আদালতের শুনানিতে বিভিন্ন সাক্ষীর বক্তব্যে উঠে আসে। বধ্যভূমিটি যাতে সংরক্ষণ করা হয়, সে জন্য আইনি লড়াই করতে হয়েছিল। আইনি লড়াই অনেক আগে শেষ হলেও অবসান হয়নি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার। যার কারণে এখনও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ‘জল্লাদখানা’খ্যাত এই বধ্যভূমি।

শেষ হয়নি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ ঃ নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, পাবলিক লাইব্রেরি ও মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তন ভেঙে সেখানে শহীদ মিনার কাম সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের বড় প্রকল্প নেয় সরকার। অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্বুল প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার। দুইশ’ ৩২ কোটি টাকার এই প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। দেড় বছর মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০২৩ সালে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে মুসলিম ইন্সটিটিউট হল ও পাবলিক লাইব্রেরি ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ও আটতলা বিশিষ্ট মিলনায়তন ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অংশে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় আড়াইশ’ জন ধারণক্ষমতার একটি উন্মুক্ত গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ তৈরি হচ্ছে। মাঝখানের অংশে থাকছে শহীদ মিনার। কথা ছিল এবারের বিজয় দিবসের আগেই শহীদ মিনারসহ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু নয় মাস সময় নিয়ে একবছর পার হতে চললেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।
প্রকল্পের নির্মাণ কাজ তদারককারী সরকারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরের চট্টগ্রম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, আমরা গত বছরের নভেম্বরে শহীদ মিনারের কাজ শুরু করতে চেয়েও বিভিন্ন জটিলতার কারণে পারিনি। শহীদ মিনারের সামনে জন-চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ যে সড়কটা আছে সেটা বন্ধ করতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এ কারণে দ্রতগতিতে কাজ করেও নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ করা যায়নি। তবে প্রকল্পের মধ্যে শহীদ মিনার অংশের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই কাজ সুসম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

আঁতুড়ঘরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ ঃ মুজিব জন্মশতবর্ষে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। নগরীর উত্তর কাট্টলীর পোর্ট লিংক রোডের পাশে ৩০ একর সরকারি জমির ওপর এ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের ঘোষণা দেয়া হয়। এ পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিও মেলে। বলা হয়, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পর এটি হবে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্মৃতিসৌধ। গত বছরের ২৮ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রস্তাবিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের জায়গাও পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিবও প্রস্তাবিত ওই জায়গা পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবহিত করেন। ব্যস! সেখানেই থমকে আছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের মহাপরিকল্পনা।