‘অনুদানের’ সিসি ক্যামেরা রক্ষণাবেক্ষণেও বরাদ্দ নেই

127

নগরীতে অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে বিত্তবানদের কাছ থেকে ‘অনুদান’ নিয়ে ছয় বছর আগে ২০১৪ সালের শেষদিকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ক্লোজ সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন কার্যক্রম শুরু করে সিএমপি। সদর দপ্তরে খোলা হয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। গোড়ার দিকে স্থাপন করা এসব ক্যামেরার অধিকাংশই নি¤œমানের। এর মাঝে কিছু ক্যামেরা চোরের কবলে পড়ে। আবার বিলবোর্ড অপসারণের সময় কাটা পড়ে অনেক ক্যামেরার সংযোগ তার। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হয় উচ্চ প্রযুক্তির আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ক্যামেরা বসানোর কাজ। কিন্তু এজন্য সিএমপির সুনির্দিষ্ট কোনও বাজেট বরাদ্দ না থাকায় ছয় বছরেও অনুদাননির্ভরতা থেকে সংস্থাটি বেরিয়ে আসতে পারেনি।
প্রযুক্তি-বিশারদরা বলছেন, সিসি বা আইপি ক্যামেরা কেবল বসিয়ে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার বিষয়টিও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, কোনও স্থাপনায় ইনডোরে লাগানো ক্যামেরা ও সংযোগ তার যতটা নিরাপদ থাকে, আউটডারে বা উন্মুক্তস্থানে ততটা থাকে না। উল্টো তুলনামূলকভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া বা ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি।
সম্প্রতি নগরীর ব্যস্ততম দুই নম্বর গেটে পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণ-কান্ডে ঘটনাস্থলের দিকে তাক করে লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলো অকেজো অবস্থায় আবিষ্কার করে পুলিশের তদন্ত টিম। অকেজো থাকায় এগুলো থেকে কোনও ফুটেজও পায়নি পুলিশ। এ ঘটনার পর পুলিশ কমিশনার সিসি ক্যামেরার বিষয়টিকে ফের গুরুত্বের সাথে দেখভাল করার জন্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের উপ-কমিশনারদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছেন। তারা অধঃস্তন কর্মকর্তা ও থানার ওসিদের প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে তাগাদা দিয়ে চলেছেন। তবে, সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দের কোন সংস্থান করা হয়নি। নগরীতে এরইমধ্যে আইপি ক্যামেরা স্থাপিত হয়েছে ২৯টি। এর মধ্যে সচল আছে ১৯টি। আর পুরনো ৭৫টি ম্যানুয়েল ক্যামেরার মধ্যে ৬৯টিই অচল। সে হিসাবে নগরীতে পুলিশের তত্ত¡াবধানে স্থাপিত মোট একশ’ চারটি ক্যামেরার মধ্যে মাত্র ২৪টি সচল আছে। বাকি ৭৯টিই অচল।
সবমিলিয়ে ১৬টি থানায় বিভক্ত নগরীর প্রতি ইঞ্চি এলাকাকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার জন্য পুলিশ নানাভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে দাবি করে সিএমপির উপকমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক বলেন, ‘নগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে আমরা শহরের প্রতি ইঞ্চি জায়গা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার কাজ করছি। আমাদের নিজস্ব তহবিলের অর্থে যেমন ক্যামেরা বসানোর কার্যক্রম চলছে, তেমনি ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নিজ নিজ স্থাপনা এবং আশপাশের এলাকার নিরাপত্তার জন্য ক্যামেরার আওতায় আনার চেষ্টা করছেন। একটু সময় লাগলেও আমরা পুরো কাজটা সুসম্পন্ন করতে পারবো বলে আশা করি।
সিএমপি সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৩০ জুন সিএমপি নগরীতে প্রথমবারের মত আইপি ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন কার্যক্রম উদ্বোধন করে। ডিজিটাল সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের আওতায় এবং ক্যাবল অপারেটর সিসিএল-এর সহযোগিতায় নগরীর ১৬ টি অপেক্ষাকৃত অপরাধপ্রবণ ও গুরুত্বপূর্ণ জংশনে চালু করা হয় সিসি ক্যামেরা। পাশাপাশি বিপদগ্রস্থ মানুষের সেবায় মোবাইল এপ্লিকেশন এবং চোরাই গাড়ি উদ্ধারে ‘ভেহিক্যাল থিফ্ট এন্ড রিকভারি ডাটাবেজ’ সেবা চালু করে পুলিশ। যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও কাজে লাগে এসব ক্যামেরা। সদর দপ্তরে খোলা হয় এসব ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণকক্ষ। এছাড়া নাগরিকদের বিপদে থানা পুলিশের সাহায্য পেতে মোবাইল এপ্লিকেশন সিস্টেম এবং চুরি যাওয়া গাড়ি শনাক্তকরণ, উদ্ধার ও প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দিতে চালু করা হয় ‘ভেহিক্যাল থিফট এন্ড রিকভারি ডাটাবেজ।’ নাগরিক সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালীরা এতে অর্থায়ন করে। প্রথম পর্যায়ে নগরীর অপেক্ষাকৃত অপরাধপ্রবণ আকবর শাহ, দেওয়ানবাজার, কাজীর দেউড়ি, চকবাজার, অক্সিজেন, সিটিগেট, কাপ্তাই রাস্তার মাথাসহ ১৬ টি স্পটে মোট ৫৬ টি ক্যামেরা বসানো হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এসব ক্যামেরার বেশিরভাগই অকেজো হয়ে পড়ে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) আবু বকর সিদ্দিক জানান, গোড়ার দিকে লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলো ম্যানুয়েল পদ্ধতির ছিল। সেসব ক্যামেরা কম সময়ে অকেজো হয়ে যায়। এখন উন্নত প্রযুক্তির উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আইপি ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নগরীর চারটি অপরাধ বিভাগকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে সদরঘাট, ডবলমুরিং, পতেঙ্গা, বন্দর, ইপিজেড ও কর্ণফুলী থানা এলাকায় ক্যামেরা স্থাপনের কার্যক্রমে বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে। অচিরেই পুরো নগরীই ক্যামেরার আওতায় আনতে পুলিশ সক্ষম হবে।
সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ অনুদাননির্ভরতায় চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন মাঠ পর্যায়ে কর্মরত অধিকাংশ পুলিশ কর্মকতা। তারা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী থানা এলাকার বিত্তবানদের কাছ থেকে ‘অনুদান চেয়ে’ সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ খাতেও কোনও বরাদ্দ নেই। অথচ, এটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি অতি জরুরি। বছরখানেক আগে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) ও সিটি করপোরেশনকে (চসিক) পুলিশের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে ক্যামেরাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হলেও সাড়া মেলেনি।
বিকল্প ব্যবস্থার সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ নিজস্ব উদ্যোগেই ক্যামেরা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের কার্যক্রম চালিয়ে নেবে উল্লেখ করে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) আমেনা বেগম বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি তো পুলিশকেই দেখতেই হয়। তাই সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ না থাকলেও বিত্তশালী বা দানশীল ব্যক্তিদের সিএমপির তহবিলে প্রদত্ত অনুদান থেকেই আইপি ক্যামেরা লাগানোর কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে ক্যামেরা লাগানোর কাজ শেষ করা হবে।’