অনিষ্পন্নই রয়ে গেল তিন পার্বত্য জেলায় ভূমি বিরোধ

33

এম কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৯৯ সালে পার্বত্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালে চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনও প্রণয়ন করে সরকার। আইনে বলা হয়েছিল- আদালতের সিদ্ধান্তগুলো দেওয়ানি আদালতের রায়ের মতো হবে এবং কোথাও চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনে কমিশনকে কাজ করার জন্য একগুচ্ছ নিয়ম প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। কিন্তু ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকার তা করেনি। বরং ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন করা হয় যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কমিশনারের ক্ষমতা হ্রাস করা হয় এবং ২০০১ সালে চট্টগ্রাম জমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে থাকা ছয় মাসের মধ্যে কমিশনের জন্য বিধি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সরিয়ে দেয়।
বর্তমানে কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। বিপুল সংখ্যক মামলা থাকা সত্ত্বেও নানান বাধায় জমি বিরোধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।২০১৮ সালের ১২ ফেব্রæয়ারি রাঙামাটি সার্কিট হাউসে কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার-উল-হকের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের বিক্ষোভকারীরা কমিশনের আইন সংশোধনের দাবিতে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ঘেরাও করে।
কমিশনে বর্তমানে প্রায় ২৩ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কমিশনের বৈঠক বা অন্যকোনো কার্যক্রম পরিচালনার সময় প্রতিবাদ করে আসছে একটি সংগঠন। সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের গত ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় বৈঠক ও ৭ দফা দাবিতে ৬ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল ৬টা থেকে রাঙামাটি শহরে ডাকা হয় টানা ৩২ ঘন্টার হরতাল। হরতালের প্রথমদিন দুপুরেই এক আদেশে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক স্থগিত করেন ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সচিব মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন।
নাগরিক পরিষদের ৭ দফা দাবিগুলো হচ্ছে- ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে জনসংখ্যা অনুপাতে সকল জাতিগোষ্ঠী থেকে সমান সংখ্যক সদস্য নিশ্চিত করা; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এর কার্যক্রম শুরুর পূর্বে, ভূমির বর্তমান অবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভূমি জরিপ সম্পন্ন করা; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল স¤প্রদায়ের মানুষের ভূমির ওপর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের সংবিধানের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’ ভূমি কমিশন সংশোধনী আইন ২০১৬ এর ধারা সমূহ বাতিল করা; পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রবর্তন করতে হবে এবং সমতলের ন্যায় জেলা প্রশাসকগণকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার দেয়া; কমিশন কর্তৃক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কারণে কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি খাসজমিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘তথাকথিত’ রীতি, প্রথা ও পদ্ধতির পরিবর্তে দেশে বিদ্যমান ভূমি আইন অনুসারে ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা; বাংলাদেশ সরকারের আদেশ অনুযায়ী জেলা প্রশাসক কর্তৃক বন্দোবস্তীকৃত অথবা কবুলিয়তপ্রাপ্ত মালিকানা থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের দাবি পার্বত্য ভূমি কমিশন এখনও পুরোপুরি সক্রিয় নয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ভ‚মিবিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে ‘পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বা ল্যান্ড কমিশন’। গঠনের দীর্ঘ দুই দশক পরও এ কমিশনের কার্যক্রমে অগ্রগতি নেই। কমিশনে জমছে অভিযোগের পাহাড়।
জমা পড়া এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াই শুরু করতে পারেনি কমিশন। ফলে পাহাড়ে ভূমিবিরোধ বাড়ছে প্রতিদিনই। এ পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলা থেকে ২৩ হাজারের বেশি মামলা কমিশনে জমা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পার্বত্য ভূমি কমিশনের কাজ এখনও সীমাবদ্ধ বৈঠকের মধ্যেই। কশিনের প্রধান কার্যালয় খাগড়াছড়িতে। রাঙামাটিতে একটি শাখা অফিস খোলা হয়েছে। গত বছর ২৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাঙামাটি জেলা পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে খোলা হয় শাখা অফিসটি। পরবর্তী ২৩ ডিসেম্বর রাঙামাটি শাখা কার্যালয়ে কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে আইনি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে ২৩ বছরেও কমিশনের কাজে অগ্রগতি নেই। শুরু থেকেই সক্রিয় হতে পারছে না এ কমিশন। ফলে ব্যর্থতা ছাড়া কোনো সুফল নেই কমিশনের ঝুলিতে।
কমিশন সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কাজ শুরু হলে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কমিশনে জনবল সংকট। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়া না হলে কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে না। এজন্য অবিলম্বে জনবল নিয়োগ দরকার। ২০১৬ সালের আগস্টে কমিশনের আইনি জটিলতা দূর করতে সাংঘর্ষিক ও বিরোধাত্মক ১৩ ধারা সংশোধন করা হয়েছিল। এরপর কেবল সভাতে কমিশনের কার্যক্রম ঘুরপাক খাচ্ছে।
কমিশন চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ার-উল হক বলেন, গত বছর ২৩ ডিসেম্বরের কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাঙামাটি জেলা শাখা অফিসে। পরবর্তী বৈঠকের পরেই পাহাড়ে বিদ্যমান ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দাখিল করা মামলাগুলোর আবেদন যাচাই-বাছাই শুরু হবে।
সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সব কিছুতে ভ‚মির বিষয়টি জড়িত। অথচ পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে এখনও ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। দীর্ঘ ২২ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এরপরও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি সরকার। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত মৌলিক বিষয়গুলো থমকে আছে।
চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের মাধ্যমে পাহাড়ে নিরপেক্ষভাবে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে যে সুপারিশমালা পাঠিয়েছে, সেটি দ্রুত প্রণয়ন করা হলে কমিশনের কাজ এগিয়ে যাবে। ফলে পাহাড়ে ভূমি নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।