অনলাইনের থাবা, বিকারগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে সমাজ

11

আকতার কামাল চৌধুরী

আমাদের বাঙালি সমাজে যৌথ পরিবার একটি ঐতিহ্য। এই তো, দুই/তিন দশক আগেও এর চর্চা ছিল ব্যাপকভাবে। দাদা কিংবা বাপ-চাচাদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ তিনিই পরিবারের কর্তা। পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত তাঁর অনুমতির উপরই নির্ভারশীল। ঘরের কাজকর্ম থেকে সবকিছুই তাঁর হুকুমে চলতো। এই যৌথ পরিবারে ‘আমার’ বলে কোনো আলাদা স্বত্বা ছিল না, ছিল ‘আমাদের’। একসাথে নাওয়া-খাওয়া, একসাথে খেলাধুলা, সবই একসাথে। পুকুরঘাটে সে এক উৎসব। কেউ গোসল করছে, কেউ সাঁতার কাটছে। আবার কেউ কেউ দল বেঁধে সাঁতরে পুকুর পাড়ি দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বড়োরা ছোটদের ধরে ধরে গা ডলে গোসল করাচ্ছে। বড়দের হাত গলিয়ে পালাতে গিয়ে অনেকসময় চড়থাপ্পড়ও কপালে জুটতো ছোটদের। বাবার হাতের গোসল মানে শক্ত হাতের অনাচার। এই অনাচারে অনেকসময় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিত বাচ্চারা। সেই সুখস্মৃতি এখন বিস্মৃত প্রায়।
কী শহরে, কী গ্রামে, এখন ঘরে ঘরে গোছলখানা। পাতালের পানিতেই সব সাবাড়। পুকুরের প্রয়োজন শুধু ঐতিহ্য আর মাছের প্রয়োজনে। গোসলের সেই উৎসব আর নেই, নেই জাল দিয়ে একসাথে মাছ ধরার আনন্দও। পুকুরের মাছ বেচার রেওয়াজ ছিল না বললেই চলে। সারা বছর যে কেউ মাছ ধরতে পারতো। বছরে একবার জেলেদের ডেকে বড়ো জাল ফেলে মাছ ধরা হতো। জাল টেনে কূলের দিকে আনার সময় বড়ো বড়ো মাছের সেই হুলুস্থুল লাফালাফি, দাপাদাপি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। পুকুরপাড়ে জড়ো হওয়া বাচ্চাদের দল এই দৃশ্য দেখে খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠতো। জেলেদের ভাগ বুঝিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র খাজনাপাতি পরিশোধ করার নিমিত্ত কিছু মাছ বিক্রি করে অবশিষ্ট মাছ চাচা-জ্যাঠা ও পড়শিদেশের মধ্যে ভাগভাটোয়ারা করে দেওয়া হতো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য- তখন কমপক্ষে দুই সের ওজনের কম কোনো মাছ ধরা হতো না।
রান্না ঘরে পিঁড়িতে কিংবা চাটাই বিছিয়ে মা-দাদীর কড়া নজরদারিতে প্রথমে ছোটদের খাওয়া-দাওয়া, এরপর বড়োদের। সবশেষে মহিলারা। বাঙালি সমাজে পুরুষের আগে মহিলারা খায়-ই না। খাওয়া-দাওয়ায় শাশুড়ীর সামনে বিশেষ সতর্ক বউয়েরা। মাথার কাপড়, বসার ভঙ্গি, খাওয়ার স্টাইল- সবকিছুতে বউ মানে বউ-ই। এরমাঝেও বউদের প্রতি শশুড়কূলের আলাদা একটা মায়া থাকতো। এটা অনেক শাশুড়ী মানতে পারতেন না। তারা বউদের কড়া শাসনে রাখার পক্ষে। বাঙ্গালী পরিবারের বউ-শাশুড়ীর এই দ্বা›িদ্বক সম্পর্ক নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে।
আম, জাম, পেয়ারা এ-গাছগুলো গোষ্ঠিতে একটা থাকলেই ব্যস, সবাই ঐ গাছের ফল পেড়ে খাওয়ার এক অঘোষিত সামাজিক অধিকার লাভ করে। এই অধিকার অবশ্য ছোটদের বেলায়, বড়োরা থাকতেন শাসকের ভূমিকায়। কিন্তু সেই অধিকারে টান দিয়েছে আধুনিক সভ্যতা। সেই ফলফলাদির গাছের সারি গ্রামেগঞ্জে আজকাল তেমন দেখাই যায়না। দলবেঁধে বরই গাছে ঢিল মারার দৃশ্যও ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। উঠোনে শিশু-কিশোরের নেই দুরন্তপনা, নেই হাঁক-ডাক, চিল্লাফাল্লা। মা-বাবার কড়া শাসনে ঘরেই বন্দী তারা। স্কুলের হোমটাস্ক, গৃহশিক্ষকের রুটিন পড়া-রোদেলা দুপুরের গাছের ছায়াকে উপভোগ করতে দেয় না। তাদের সময় নেই রাতের চাঁদ দেখার, জোৎস্না দেখার। দেখবেও বা কীভাবে, তাদের চক্ষুস্থির নেট দুনিয়াতেই, একবার প্রবেশ করলে আর ফিরে আসার হুঁশই নেই।
পরীক্ষা শেষে বাচ্চারা এখন নানা বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বায়না করে না। বউয়েরাও লম্বা সময়ের জন্য বাপের বাড়ি নায়র করে না। জামাইদেরও সময় নেই শশুর বাড়ির পুকুরে মাছ ধরার।
অনলাইনে আত্মীয়দের নিয়ে হরেকরকম গ্রুপ খোলা আছে ; নিত্যকার খবর ওখানেই পাওয়া যায় ; নিজেরটাও ওখানে শেয়ার করে। দেখার বেশি প্রয়োজ-আহ্লাদ জাগলে একটা ভিডিও কল,ব্যস। কারো মৃত্যু কিংবা খুব নিকটজনের অনুষ্ঠান ছাড়া রক্তমাংসের দেহগুলোর কাছাকাছি আসার সময় হয়না। আপনজনের মৃত্যুতে ফেসবুকে একটি জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিয়েই দায়িত্ব শেষ। জানাজার নামাজের দায় সেরেই লাশ সৎকার পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময় নেই এখন কারো কাছে। সবাই পলায়নপর, ব্যস্ত দুনিয়ায় গা বাঁচাতে ব্যস্ত। কারো দূর্বিষহ কাহিনি শোনার সময় নাই।
ভাইপো-ভাইঝিরা এখন অভিযোগ, অনুযোগের পাহাড় নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় ফুফুর গলা জড়িয়ে মা-বাবার বিরুদ্ধে নালিশ করে না। খালাদের শরীরের গন্ধ শোঁকার ফুরসত নেই ভাগিনা-ভাগিনীদের। সম্পর্কের দায় অনলাইনেই মিটমাট। আমাদের পরিবারগুলো যেন একেকটা অনলাইন জেলখানা। এই জেলখানার সেলে সেচ্ছাবন্দি সবাই। এভাবে আত্মীয়তার সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটছে দিনদিন। মাঠে-ঘাটে, পুকুর পাড়ে, গাছের তলায় বন্ধুদের জমজমাট আড্ডা আর নেই। কথার খেই হারিয়ে বন্ধু বন্ধুর ঘাড়ে বন্ধু ঢলে পড়ে না। অট্টহাসিতে মাঠঘাট কেঁপে ওঠে না। আড্ডা যে নাই তা কিন্তু নয়,সেই আড্ডা ফেইসবুক কমেন্টে, মেসেঞ্জারে, হোয়াটসএপে। আড্ডা তো নয়, যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন সবাই। একহাত দূরে কী হয়ে যাচ্ছে সে খবর কারোই নেই। অনলাইন সভ্যতা আমাদের একা করে দিচ্ছে, নীরব করে দিচ্ছে।
ঈদে-পার্বনে দল বেঁধে ঘরে ঘরে কোলাকুলি আর সেমাই খাওয়ার দিন পেরিয়ে এসেছি বহু আগে। এরপর ঈদের নামাজ পড়ে টিভি সেটের সামনে বসে বেশ লম্বা সময় কাটানোর রেওয়াজ তৈরি হয়। ফেসবুক সেটাও কেড়ে নেয়। এটি পরিবার-পরিজনসহ ড্রয়িং রুম থেকে সবাইকে ঠেলে বের করে নিয়ে আসে। একা একা নিরবে-নিভৃতে হাতের মুঠোয় দুনিয়া দেখার নেশা পেয়ে বসে সবাইকে। বাইরের কোলাহল, হাসি-ঠাট্টা, রঙ-তামাশা যেন আর স্পর্শ করে না। একাতেই স্বস্তি, একাতেই শান্তি। ফেসবুক নামের এই মাদক ছাড়া জীবনটাই যেন আজ অচল, অসার।
এখন আধুনিক কবিতার যুগ। ছন্দোবদ্ধ কবিতারা লেজ তুলে পালিয়েছে সাহিত্য থেকে। ছন্দ নাই, তাই ‘ছন্দপতনেরও ভয় নাই’। ছন্দ মিলাতে গিয়ে এখন কেউ ‘সেকেলে’ কবির তকমা নেওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নন। তাই কবির সংখ্যাও এখন অসংখ্য। ফেসবুক তো নব-কবিদের সিংহদ্বার খুলেই দিয়েছে। আমাদের অভাবনীয় কবিস্বত্বার খবর জাকারবার্গ নিশ্চয়ই আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।
বাণী-সূর সমৃদ্ধ গানের জায়গা দখল করে নিয়েছে হালকা কথায় হালকা সূরের চাটুল গান। মানুষ এখন গান শোনে না,দেখে। গান এখন সাহিত্য থেকে বিচ্যুত। গভীর কথামালার সাথে সুরের তরঙ্গ মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে অচিন জগতে হারিয়ে যাওয়া এখন দুষ্কর বটে। গানের কথায় শরীরে শিহরণ জাগায় না, সুরে ঝংকারও তোলে না। সবাই চায় সাময়িক আমোদ, মনোরঞ্জন, উন্মাদনা।
বড়োদের দেখলে চা দোকান থেকে ছোটদের বেরিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ক্রমশ লঘু হয়ে আসছে। এলাকায় এলাকায় কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কী এক দূর্বিনীত স্বপ্ন সারাক্ষণ তাড়া করে তাদের। কী হতে পারলো, আরও কী কী হওয়ার বাকি আছে, এলাকায় তার প্রভাবপ্রতিপত্তির কোনো ঘাটতি আছে কি না- ইত্যাদি দেমাগি চিন্তায় সারাদিন পাড় করে এই কিশোর গ্যাং। শ্রদ্ধা, স্নেহ, দায়িত্ব, মূল্যবোধ- এগুলো মরা ইস্যু তাদের কাছে। জনসম্মুখে কোনো ভদ্র মানুষের গালে কষে চড় মারতে পারলে কিংবা, তার পরিবারকে কষে গালাগাল দিতে পারলেই আপনি এলাকার কীর্তিমান পুরুষ। নিজেকে ক্ষমতাবান দেখানোর চলমান ব্যারোমিটার আপাতত এটাই। ভদ্রতা মানে দুর্বলতা, অক্ষমতা। এই অপবাদের বোঝা খামাকা কেন কাঁধে নিতে চাইবে তারা।
এভাবে পঁচন ধরেছে আমাদের চিন্তা-চেতনায়। ভেঙে পড়ছে সামাজিক মূল্যবোধের দেওয়াল। আলগা হয়ে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধন, আত্মীয়তার সম্পর্ক। মনের ভেতর থেকে সুকুমার বৃত্তিগুলো মরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ইট-পাথরের গগনচুম্বী অট্টালিকার বদ্ধ কুঠুরীতে করতলকৃত আকাশ সংস্কৃতিতে বন্দী এই প্রজন্ম। সম্পত্তির জন্য পুত্র তার মায়ের বুকে গুলি চালায়, অতি আধুনিক কন্যা আধুনিকতার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নিজের জন্মদাতা পিতা এমনকি গর্ভধারিণী মাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এগুলো আধুনিক সভ্যতার বিকারগ্রস্ত সমাজের বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কের বড়ো উদাহরণ। সত্যি বিকারগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে সমাজ।
লেখক: প্রাবন্ধিক