মাওলানা সৈয়দ সামশুল হুদা (কঃ)

140

মানবদেহ নামক এক পিঞ্জরায় আত্মা বা রুহ্ যেদিন থেকে আবদ্ধ হয়েছে, সেদিন থেকে মূল তথা পরমাত্মার জন্য মানব সন্তানের বিরহবেদনার প্রথম প্রকাশ ঘটে জন্মলগ্নে প্রতিটি মানবসন্তানের কান্নার মাধ্যমে। হযরত আল্লামা জালালউদ্দিন (রাঃ) মানবসন্তানের এই বিচ্ছেদ বেদনাকে বাশারির কান্নার সাথে তুলনা করেছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল বলেন ‘নিতি হাহাকার উঠিত ওবুকে কাহার মহাবিরহ? অসহ নিবিড় বেদনা কেন যে জাগাইত অহরহ? সে কি মোর আল্লাহ’! মানব সন্তানের বয়সের সাথে সাথে দুটি প্রেম সত্তার বিকাশ ঘটে একটি ইন্দ্রীয় বা দেহজ অপরটি অতিন্দ্রীয় বা মরমী। প্রেমের ক্ষনস্থায়ী বাধন ভেদ করে ঐশী প্রেমের জাগরণ ঘটতে দেখা যায় ঐতিহাসিক অমর প্রেমগাঁথা লাইলী-মজনুর ক্ষেত্রেও। তাই বিরহ বিচ্ছেদে ব্যাকুল লায়লী যখন মজনুর কাছে ছুটে আসে তখন মজনু বলেন-
‘খোদার প্রেমের পরশ মানিক, পেলাম হঠাৎ ভুলে,
মজনুরেও যে লাইলী ভুলায়, ও সে কত সুন্দর
বুঝিবে লাইলী যদি তুমি তারে, নেহার এক নজর…’।
খোদার প্রেমের অশেষ প্রাবল্য প্রেরনা নিয়ে জগতের বুকে কিছু ক্ষনজন্মা মহা পুরুষের আবির্ভাব মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে থাকে। যাঁদেরকে খোদার প্রেমের যিয়নকাঠি বা পরশমানিক বলা যায়। আমার আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য সেই মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব আওলাদে রসুল সুলতানুল আরেফীন হযরত শাহছুফী সৈয়দ মাওলানা সামশুল হুদা (কঃ) মাইজভাণ্ডারী । ত্বরীকা-এ-মাইজভাণ্ডারী প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম শাহছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) মাইজভাণ্ডারী , গাউছুল আযম বাবা ভাণ্ডারী , সৈয়দ খায়রুল বশর কেবলা-এ-আলমের সুযোগ্য উত্তরসূরি। দুই মহান অলিকুল শিরোমনির আধ্যাত্মিক মহামিলনের মোহনাস্বরূপ আল্লাহর নেয়ামত বিতরণ ও বিকিরনের এক অসাধারণ ঐশী ফোয়ারা হিসাবে নেয়ামত-সন্ধানী মানুষ যখনই হযরত সৈয়দ সামশুল হুদা (কঃ) এর সান্নিধ্যে আসতো সাথে সাথে তাঁর কৃপা বা দয়া লাভ করতো। সৈয়দ সামশুল হুদা (কঃ) মাইজভাণ্ডারী প্রায় ৩০ বছরাধিক নির্বাক জীবনযাপন করেন। তাঁর এই নীরবতা সম্পর্কে লেখকের মনে প্রশ্ন ছিল তিনি কি কোন অসুস্থতাজনিত কারণে নির্বাক? নাকি স্বেচ্ছায় বাকসংযম করছেন? এই কৌতুহল নিবারনের জন্য একদিন সম্ভবত ১৯৭২ সনের ৫ এপ্রিল বাবা ভাণ্ডারী ওরশ শরীফে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হতেই তিনি হঠাৎ আমাকে বলে উঠলেন এক পেকেট সিগারেট এনে দাও লিখতে পারবে। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম তিনি মূলতঃ বাকসংযম করছেন। তিনি বোবা নন, যুগ যুগ পেরিয়ে আমি সত্যিই লিখতে পারছি।
সৈয়দ সামশুল হুদা (কঃ) মাইজভাণ্ডারী এক নীরব বাকসংযমী উচ্চ পর্যায়ের অর্থাৎ আরেফগণের কাফেলায় এক ‘সর্দারে অলী’ ছিলেন। তাঁর অসংখ্য কারামত রয়েছে। ইতোমধ্যে তাঁর একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার কলেবর বৃদ্ধি না করার জন্য তাই কারামতের বিস্তারিত বর্ণনা না করে তাঁর জীবনাদর্শনের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনি ছিলেন দুর্লভ ও অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একজন মহান অলি-কামেল। মানুষকে অন্তর দিয়ে অর্থাৎ রূহানী শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার যে অতুলনীয় শক্তি তিনি দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন তা যাঁরা নিজেদেরকে তাঁর কদমে সমর্পন করেছিলেন তাঁরাই একমাত্র উপলব্ধি করেছেন। সরাসরি মুখে কোন নির্দেশনা না দিয়ে জগতের নানা জটিলতা থেকে মুক্ত করে মানুষকে আল্লাহ ও রাসুলের দেখানো পথে গতিশীল রাখা কতো দুরূহ তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখেনা। বাবাজান সৈয়দ সামশুল হুদা (কঃ) দীর্ঘ সময় কথা না বলে অন্তর দিয়ে তাঁর ভক্তকুলকে সুশাসন দ্বারা ইহদিনাছ সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে গতিশীল রাখতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ‘সুলতানুল আরেফীন’।
মাইজভাণ্ডারী শায়েরগণ তাই বলেন ‘মুখে নাহি কথা বলে টেলি চালায় দিলে দিলে’। আরেফগণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ‘তাকওয়া’ অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন। এ প্রসঙ্গে সুলতানুল আরেফীন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রাঃ) এর একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো- ‘একদিন হযরত বায়েজিদ (রাঃ) কোন এক শহরে সফরে ছিলেন। মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করে আস্তানায় ফিরে আসলে উক্ত মসজিদের ইমাম সাহেব তাঁর সাক্ষাতে আসেন, ইমাম সাহেব হযরতকে প্রশ্ন করলেন- আপনি চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই করেন না, কেউ হাদিয়া নজর দিলেও তেমনটা নেননা, আপনার সংসার কিভাবে চলে? তখন হযরত বায়েজিদ (রাঃ) বলেন আপনি বসুন, আমি ওয়াক্তের ফরজ নামাজ আদায় করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব।
ইমাম সাহেব বললেন হুজুর এখনি না আপনি জামাতে নামাজ পড়লেন? হযরত বললেন এই মুহ‚র্তে আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন তাতে আমি নিশ্চিত হয়েছি আপনার পেছনে আমার নামাজটি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়নি। কারণ যে মোমেন মুসলমান আল্লাহর উপর নির্ভর না করে আগামী দিনের রুটি রুজি নিয়ে চিন্তা করে তার তাকওয়া বা আল্লাহর উপর নির্ভরতা দুর্বল হয়ে যায়। তার পেছনে নামাজ আল্লাহ কবুল করবেন না। তাই আমার উপর আবার ওয়াক্তের নামাজ ফরজ হয়ে গেছে’।
এই ঘটনা প্রমাণ করে তাকওয়ার পরিপূর্ণতা যার আছে তিনিই আরেফ। হযরত সৈয়দ সামশুল হুদা (কঃ) জীবনে কোন দিন জীবিকার জন্য সংসারের জালে আবদ্ধ হননি। নবীর সুন্নাত হিসেবে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেও জগতের কোন কালিমা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি পরম হংসের মত। সরোবরে থাকা নিদাগ, পুত-পবিত্র, আল্লাহ রাহে সমর্পিত সত্তাগণের অন্যতম এক মাইজভাণ্ডারী মহাসিদ্ধ পুরুষ। তাঁর সিলসিলা ছিল মগ্ন চৈতন্যের অন্যতম প্রধান মাইজভাণ্ডারী সাধক-সম্রাট গাউছুল আজম শাহছুফী সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভাণ্ডারী (কঃ) এর সিলসিলা। মাইজভাণ্ডারী পরিবারের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরসূরি, নির্বাক এক মহান অলিয়ে কামেল।
সৈয়দ সামশুল হুদা (কঃ) মাইজভাণ্ডারীর পবিত্র ওরশ শরীফ প্রতি বছর ১ মাঘ মহা-সমারোহে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার শরীফে অনুষ্ঠিত হয়। ভোগবাদী বিশ্বের দুনিয়াবী নানা জটিলতা ভেদ করে আল্লাহ তথা প্রভুর দরবারে কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘প্রভু তব দয়া দিয়ে হবে আমার জীবন ধুতে, নইলে কীগো পারব তব চরণ ছুঁতে’ এই আকুতি নিয়ে মাইজভাণ্ডারী ভক্তরা দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে চলেছেন মাইজভাণ্ডার অভিমুখে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা প্রভু তোমার পানে….. মহাপ্রান মাইজভাণ্ডারীর ঐশী প্রেমের টানে যেন ছুটে চলেছেন প্রভুর দয়া পাওয়ার আশায় লাখো জনতা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের দিকে’।
পরিশেষে মহান আল্লাহর দরবারে এই মহান দিনে আমাদের ফরিয়াদ হোক ‘হে খোদা আমাদেরকে আপনার নেয়ামতপ্রাপ্ত অলিগণের অনুসৃত পথে চলার তৌফিক এনায়েত করুন’। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক