বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমলে নিতে হবে

12

২০১৭ সালে আগস্টে নতুনভাবে রোহিঙ্গাদের যে ব্যাপক সংকট বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে পড়ল, তা এখন আর বাংলাদেশের একার সংকট নয়; পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই সংকটে রূপ নিতে যাচ্ছে, যার দায় বিশ্ব সম্প্রদায় এড়াতে পারে না-এমনটি কথা দীর্ঘদিন থেকে বলা হলেও এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এবং স্পষ্ট ভাষায় জাতিসংঘের অধিবেশনে ব্যক্ত করেছেন। গত শুক্রবার জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের দমন অভিযানে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অনিশ্চয়তা যে আঞ্চলিক সংকটের মাত্রা পেতে যাচ্ছে, তা বিশ্বকে উপলব্ধি করার আহবান জানিয়েছেন। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা জনস্রোত যখন নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে তার এক মাসের মাথায় এই জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে সংকটের সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমার সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় গত বছর জাতিসংঘ অধিবেশনে হতাশা প্রকাশ করে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু দুইটি বছর গত হওয়ার পরও এর কোন যৌক্তিক সমাধান না হওয়ায় দুঃখজনকভাবে এবারও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে পুনরায় উত্থাপন করতে হয়েছে। এবার তিনি বিশ্ব নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আমরা এমন একটি সমস্যার বোঝা বহন করে চলেছি যা মিয়ানমারের তৈরি। এটি সম্পূর্ণ মিয়ানমার এবং তার নিজস্ব নাগরিক রোহিঙ্গাদের মধ্যকার একটি সমস্যা। তাদের নিজেদেরই এর সমাধান করতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। দুই দফায় প্রত্যাবাসন শুরুর দিনক্ষণ ঠিক হলেও তা পিছিয়ে যায় এখনও সেখানে জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের অনীহায়। এই বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যদিও রোহিঙ্গা সমস্যা প্রলম্বিত হয়ে তৃতীয় বছরে পদার্পণ করেছে, কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। রোহিঙ্গাদের স্ব-ভূমে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে জাতিসংঘে চারটি প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রস্তাবগুলো- ১. রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আত্মীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে। ২. বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে। ৩. আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় হতে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। ৪. আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণসমূহ বিবেচনায় আনতে হবে এবং মানবাধিকার লংঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা, জাতিসংঘে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশন, এসডিজি বাস্তবায়ন, বাংলাদেশের উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা ও মন্দার পরও বাংলাদেশ ১০ বছর ধরে সমৃদ্ধি ধরে রেখেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে সারা বিশ্বে আলোচিত। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জিডিপির আকার, রপ্তানি আয় ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়গুলোও উঠে এসেছে তাঁর ভাষণে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা যেতে পারে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের সাইড লাইনে তিনি বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। আলোচনায় আসামের নাগরিকপঞ্জিসহ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো স্থান পায় বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। সমন্বিত টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের ব্যাপক সফলতার জন্য গেদ্বাবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই-গ্যাভি) তাঁকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করেছে। পেয়েছেন ইউনিসেফের ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’। তাঁর এই অর্জন দেশের জন্যও গৌরব বহন করে। সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উজ্জ্বল বাংলাদেশকে তুলে ধরার পাশাপাশি সংকটের বিষয়টিও চিহ্নিত করে সমাধানের পথও দেখিয়েছেন। তাঁর প্রস্তাব বিশ্বনেতৃত্ব বিবেচনা করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।