বিশ্বাসীরা বিজয়ী হয়

140

উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘খুদি কো কর বুলন্দ ইতনা / কি হার তাক্দির ছে, পহলে / খোদা বান্দেছে খোদ পুছে / বাতা তেরী রেজা কিয়া হ্যায় ‘।
অর্থাৎ তোমার ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে বিকশিত কর যে তোমার ভাগ্য লেখার আগে স্বয়ং আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, বল বন্দা হে, তোমার ভাগ্য কী লিখব ?
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত-সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষকে মহান আল্লাহপাক সৃষ্টি করেছেন মর্যাদাবান করে। এই মানুষের রয়েছে প্রচন্ড শক্তি। মানুষের মগজ-মস্তিষ্ক শ্রেষ্ঠ সম্পদ আধুনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলা হয় আলভার্ট আইনস্টকে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক ছিল দেড় লিটার, লউ বায়রনের দিন আড়াই লিটার। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মস্তিষ্কদেড় লিটারের অধিক। বিজ্ঞানীরা হিসেব করেদেখেছেন একটি কম্পিউটারের দাম যদি হয় পঞ্চাশ হাজার টাক তাহলে দেড় লিটার মস্তিস্কের দাম হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। প্রতিটি মানুষের কাছে আছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদ, অথচ আমরা জানি না আল্লাহপাক এ পৃথিবীতে কাউকে গরিব করে পাঠাননি প্রতিটি মানুষকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার (কমপক্ষে) সম্পদ দিয়ে পাঠিয়েছেন অথচ আমরা গরিব।
মানুষ কত বড়? প্রতিটি মানুষ তাঁর স্বপ্নের চোখ অনেক অনেক বড়। কখন মানুষের মৃত্যু হয়? যখন মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু হয়। নব প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানো আমার প্রধান কাজ।
একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ সর্বোচ্চ ২৫ ভাগ শিখাতে পারে; বাকী শিক্ষা ছাত্ররা নিজেই শিখতে হয়। শিক্ষকদের মূল কাজ শিখানো নয়, স্বপ্ন দেখানো, পথ দেখানো।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী আবদুল কালাম বলেছিলেন, ‘আমরা যা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি তা স্বপ্ন নয়, যে স্বপ্ন ঘুমাতে দেয় না তা-ই স্বপ্ন’। শিক্ষকগণ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তাঁরা শুধু শিক্ষায় না ভিতরে ভিতরে নির্মাণও করেন।
কোন ছাত্র বড় নয়? যার বিশ্বাস আছে, ইচ্ছা আছে বড় হবার। অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী দেখেছি, প্রচুর মেধা থাকার পরও বড় হয়নি। কারণ তাদের প্রচন্ড ইচ্ছা ছিলনা বড় হবার। আত্মবিস্বাসই মানুষকে বড় করে। মুসলমানগণ বলেন, ঈমানই (বিশ্বাস) মূল। পৃথিবীর মধ্যে বিশ্বাসী অবিশ্বাসীর মধ্যে দ্ব›দ্ব প্রাচীন কাল হতে চলে এসেছে। বিশ্বাসীদের বিজয়ের কারণেই আধুনিক সভ্যতার জন্ম। মানব সভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির আগে অবিশ্বাসীরা বলেছিল সম্ভব নয়। বিশ্বাসীরাই কঠোর সাধনায় প্রমাণ করেছিল সম্ভব। আত্মবিশ্বাসীরা এগিয়ে গেছে এবং সভ্যতাকে বহুদূর এগিয়ে দিয়েছেন। তাই মহান আল্লাহপাক এক মহা শক্তি। সাধারণ শক্তির ওপর ঈমান এনে বিশ্বকে করেছেন পরিবর্তন। মহাশক্তির ওপর বিশ্বাস এসে ঘটাতে পারে মহা পরিবর্তন।
বিশ্বাসের কারণেই একসময় মুসলমান জ্ঞান-বিজ্ঞানে ছিল পৃথিবীর সেরা। সমগ্র বিশ্ব যখন মধ্যযুগের অন্ধকারে বাস করেছিল তখন মুসলমানদের জন্য অন্ধকার যুগ ছিল না। তখন পৃথিবীর সেরা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খলিফা হারুনুর রশিদ, (৭৮৬-৮০৯) নাম ‘খিজানাতুল হিকমা’ বা জ্ঞান গ্রন্থাগার। তারপর খলিফা মামুনুর রশীদ প্রতিষ্ঠা করেন বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউশন নাম ‘বায়তুল হিকমা’ বা জ্ঞান বিজ্ঞানের গ্রন্থাগার। (৮১৩-৮৩৩ খ্রীঃ) হালাকু খাঁ বাগদাদ নগরী যখন করে বাইতুল হিকমাতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়।
আজ মুসলমানদের জন্য মধ্যযুগ। এখন মাদ্রাসাগুলো হতে কী রসায়নের জনক জাবির ইবনে হাইয়ানের মত ব্যক্তি বের হয় ? আলোক বিজ্ঞানের জনক ইবনুল হাইসাম, গণিতবিদ আলজাবের, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সীনা, জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক আল বিরুনীর মত লোক মাদ্রাসা হতে বের হয় না কেন চিন্তা করতে হবে। তাদের মত শত মনীষীদের জ্ঞানের আলোয় ৮০০শত বছর মুসলমানরা দাপটের সাথে বিশ্বসভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করেছে। সে সভ্যতা আজকের আধুনিক সভ্যতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। বর্তমানে সভ্যতায় ‘মানুষ’ শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘মানব সম্পদ’। সম্পদের মধ্যে সেরা সম্পদ মানব সম্পদ। সবচেয়ে সেরা শক্তি ‘মানব শক্তি’। মানবিক শক্তির মানুষ আজ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। বাড়ছে জনসংখ্যা কমছে আজ মানুষ। জনশক্তি বাড়ছে মানবিক ও মানসিক শক্তি কমছে। জ্ঞান আর এখন মানসিক ও ও মানবিক শক্তি নয়। আমাদের শিক্ষা আছে, শিক্ষা ব্যবস্থা আছে, শিক্ষা নীতি আছে, আছে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা। সরকারি বেসরকারি দরকারী অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ প্রতিষ্ঠিত আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে শত শত শিক্ষার জন্য অফিস। জ্ঞানের পরিধি যাচাইয়ের জন্য আছে অনেক পরীক্ষা পদ্ধতি। বিশ্বে শিক্ষার দ্বার আজ উন্মুক্ত। কিন্তু নেই মনুষ্যত্বের শিক্ষা। যে শিক্ষার বাজার চাহিদা নেই সে শিক্ষা শিখতে কেউই আজ আগ্রহী নয়। বিশ্ব বিজ্ঞান প্রযুক্তির দিকে গেলেও দ্রূত এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশে বছর বছর কমছে বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী। বাড়ছে বাণিজ্যের ছাত্রছাত্রী। একজন লেখক নব প্রজন্মের নাম দিয়েছেন ‘ বি বি এ জেনারেশন’।
ড. জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের চার কোটি ছাত্রছাত্রী আছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের মোট জনসংখ্যা আছে ৩০-৩৫ লক্ষ। আমাদের ছাত্র ছাত্রীদের যদি সঠিক শিক্ষা দিতে পারি তাহলে দেশটা এমনিতেই দাঁড়িয়ে যাবে।’
আজকের ছাত্রছাত্রীরা আগামীর ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ গড়ার মূল সময় হচ্ছে বর্তমান। বর্তমানকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা মহাকালের যাত্রী’। অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের ওপরে আজ মহাকাল। মানুষই মহাকালের যাত্রী।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাওয়ারহেল লাল নেহরু বলেছেন, ‘আগামী ভারত কেমন হবে তা ক্লাস রুমে নির্ধারণ হয়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই।
এই দুনিয়ার বাঘ সিংহসহ অনেক হিংস্র প্রাণী আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন, যাদের শারীরিক শক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সেগুলো পশু। মানুষকে মেধা প্রদান করেছেন, তাই মেধাবীকে সম্মান করে মহান আল্লাহপাক মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মেধার কারণে ইবলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন আদম (আ.) কে সিজদা করতে। অথচ ইবলিশ ছিল ইবাদতে বড়। সে মেধাবী মানুষ যদি তার মস্তিষ্ককে ব্যবহার না করে তাহলে সে পশুর চেয়ে অধম। কারণ সে আল্লাহ প্রদত্ত মস্তিষ্ককে অপমান করেছেন।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক