বাঙালি মনীষী মাহবুব উল আলম চৌধুরী

308

বিশ শতকের বাঙালির বিকাশের সূচনা বিন্দু বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী (১৯২৭-২০০৭)। তিনি একাধারে রাজনৈতিক নেতা, সমাজ-সংগঠক, নাট্যকার ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, কলামিস্ট, সংস্কৃতিকর্মী, কবি ও ভাষা-সৈনিক। তাই মাহবুবুল আলম চৌধুরী শুধু বহুমাত্রিক লেখক নন, তিনি বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বও বটে। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা এলাকার আসাদ চৌধুরী বাড়িতে। তাঁর পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা রওশন আরা বেগম। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে যখন তাঁর বিকাশের প্রথম পর্ব তখন বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে চলছে তোলপাড়। বাংলায় তখন বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াল দুর্ভিক্ষটি হয়। এতে ৩৮ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয় যার ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গা ছড়ায়। বহু লোক প্রাণ হারায়, দেশ ভাগ হয়ে আবারও বিশ্ব ইতিহাসের বড় একটি জন-স্থানচ্যুতি হলে, বহু মানুষ দেশত্যাগী ও উদ্বাস্তু হয়, পূর্ব বাংলায় শোষণ-নির্যাতনের সূত্রপাত হয়। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে ব্রিটিশ-কূটকৌশলে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও সাস্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়। এসময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর বিভেদের রাজনীতি বিশ্বের মূল ঘটনা হলেও, তার পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ে সাম্যবাদের রাজনীতি। রুশ-বিপ্লব ও কম্যুনিস্ট রাজনীতির প্রভাবক ভূমিকা বাড়তে থাকে উন্নয়নশীল দেশের বুদ্ধিজীবী ও সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে। যুদ্ধবিরোধী শান্তি-আন্দোলনও তখন অঙ্কুরিত হয়। ভারতবর্ষের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের শহর চট্টগ্রামে বসে গ্রামের কিশোর মাহবুব উল আলম চৌধুরী ইতিহাসের এই পালাবদল প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে দাঁড়ান। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি শান্তি-সাম্য ও মানবতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হন। এভাবেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের একজন কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয়ে পড়েন। তীক্ষধী মাহবুবুল আলম চৌধুরীর অসাধারণ প্রতিভা ও পান্ডিত্য বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে সদা সক্রিয় । তাঁর রচনাবলী ও জীবনধারা থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় তিনি যথার্থই মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন এক বাঙালি মনীষী।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী স্কুল-ছাত্র থাকার সময়েই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪২ সালে মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে বিভাগপূর্ব ভারতে ‘ছাত্র ফেডারেশন’ নামে একটি মুসলিম ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগ দেন। একই বছর দি বেঙ্গল রিজিওনাল স্টুডেন্ট কনফারেন্স চট্টগ্রামেই অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে মাহবুব উল আলম মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। কনফারেন্সে কলকাতার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, ভবানী সেন এবং সুকান্ত ভট্টাচার্য। তখনই তাঁর যোগাযোগ হয় বাংলা সাহিত্যের এইসব প্রবাদ-প্রতীম ব্যক্তিত্বদের সাথে। একই বছর তিনি চট্টগ্রাম প্রগতিশীল লেখক-শিল্পি সংঘ এর সহকারী সচিব হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম নজরুল জয়ন্তী পালিত হলে তাতে অধ্যাপক আবুল ফজল ছিলেন কমিটির সভাপতি আর মাহবুব উল আলম চৌধুরী সম্পাদক। অনুষ্ঠানে কবি নজরুল ইসলামের উপস্থিতি চট্টগ্রামে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। অসুস্থ কবির চিকিৎসায় অর্থ সংগ্রহের কাজেও মাহবুব উল আলম অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে গহিরা হাইস্কুল হতে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর কলেজ পরিদর্শনে এসে ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তৃতা প্রদানকালে আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৪৭ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং এ সংগঠনের কর্মী হিসেবে তিনি ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে অংশ নেন। চল্লিশের দশকের শেষভাগে তিনি মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সুচরিত চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রথম প্রগতিশীল মাসিক সাময়িকপত্র সীমান্ত (১৯৪৭-১৯৫২)। বাংলায় যখন হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় দমবন্ধ অবস্থা তখন এই দুই ধর্মের দুজন মিলে সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়াতেই স্পষ্ট হয় তাঁদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই আদর্শকে ঊর্র্ধ্বে তুলে সৃষ্টিশীল সাহিত্যচর্চাকে উৎসাহিত করাই ছিল ‘সীমান্তের মূল উদ্দেশ্য।’ প্রথম সংখ্যাতেই প্রমাণ পাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবার দাবি নিয়ে কোনো দ্বিধা তাঁদের ছিল না। সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র যদি জনসাধারণের হয়, তবে জনসাধারণের ভাষাই রাষ্ট্রে স্থান পাবে। কারণ সে ভাষাতেই রাষ্ট্রের মঙ্গল নিহিত।’ অথচ, আজও আমরা মাতৃভাষা নিয়ে মাতামাতি করি আর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন এড়িয়ে যাই। রাষ্ট্রের মঙ্গল প্রসঙ্গে মৌন থেকে আত্ম-স্বার্থে মাতি। একারণেই হয়তো, সীমান্ত সংগ্রহ (১৯৪৭-১৯৫২) সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হলেও এসংক্রান্ত কোনো আলোচনা-অধ্যয়নের খবর আমাদের চোখে পড়ে না। ১৯৪৯ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রামে প্রথম বিশ্বশান্তি পরিষদ গঠন করেন এবং এ সংগঠনের সম্পাদক নির্বাচিত হন। পারমাণবিক বোমা নিষিদ্ধ করবার দাবীতে এই পরিষদ চট্টগ্রাম থেকেই ৭ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল। যা সুইডেনে বিশ্বশান্তি পরিষদে পাঠানো হয়। ১৯৫০ সালে মাহবুবুল আলম চৌধুরী বিশ্ব শান্তি পরিষদের চট্টগ্রাম শাখার সম্পাদক হন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে চার দিনব্যাপী সংস্কৃতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মূল সভাপতি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল ফজল, আর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তরুণ রাজনীতিক লেখক, সংস্কৃতিকর্মী মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫১ সালে যুবলীগ গঠনে মাহবুবুল সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, একই বছর তিনি চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্ত হন গণতন্ত্রী পার্টি গঠনে এবং চট্টগ্রাম জেলা শাখার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করার জন্য গঠিত কর্মী শিবিরের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই বছর কৃষ্টিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়ে চট্টগ্রামে জনগণের কল্যাণে, জনগণের দাবি আদায়ে এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিকাশে তিনি যেমন অসংখ্য আন্দোলনমুখী কাজের সূচনা করেছেন তেমনি এ লক্ষ্যে সূচিত যে কোনো কাজে তিনি জড়িত থেকেছেন।
১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সংস্কৃতিসেবীদের উদ্যোগে চার দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক লেখক-সংস্কৃতিসেবী চট্টগ্রাম থেকে এ সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনেও তাঁর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক স্কোয়াড অংশগ্রহণ করে। ১৯৬৫-৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দুটি অংশের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে দলটি দ্বিখন্ডিত হয়ে যাবার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন এবং শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকেন।
রাজনীতি-সচেতন সাংস্কৃতিক কাজে বিপুল ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখালেখি করেছেন; সাহিত্যচর্চা করেছেন। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কবিতার সংখ্যাই বেশি। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ (গ্রন্থাকারে প্রকাশ: ১৯৮৮) তাঁর সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ। এর আগে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো : চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘আবেগধারা’ (১৯৪৪), কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ইস্পাত’ (১৯৪৫) ও ‘অঙ্গীকার’ (১৯৪৬)। শেষ জীবনে লেখা তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে : ‘সূর্যাস্তের রক্তরাগ’ (২০০৪), ‘সূর্যের ভোর’ (২০০৬), ‘গরাদ ভাঙার সংগ্রামীরা জাগো’ (২০০৭), ‘অদর্শনা’ (২০০৮), ‘ক্লান্ত বাঁশির সুর’ (২০০৮), ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে’ (২০০৮)। এ ছাড়া ‘ভাঙন’ (১৯৪৩), ‘দারোগা’ (১৯৪৪) ও ‘আগামীকাল’ (১৯৫৩) নামে তিনটি নাটক লিখেন এবং বিভিন্ন নাট্যসংগঠন গড়ে তোলে তিনি জনসচেতনতা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। ‘বিষের নেশা’ (১৯৪৬) নামে একটি উপন্যাসও তিনি লিখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ঔপন্যাসিক মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮Ñ১৯৮১)ও চট্টগ্রামের সন্তান। তাঁর পৈতৃক নিবাস ফতেপুর হলেও জন্ম মাতুলালয় ফতেয়াবাদ গ্রামে। যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন এবং পরে মফিজন (১৯৪৬) উপন্যাস লিখে খ্যাতি লাভ করেন। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘বিপ্লব’ (১৯৪৭) নামের পুস্তিকাটি তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৫৬ সালে ‘মিশরের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে আর একটি পুস্তক চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। শিশু-কিশোরদের জন্য ‘আমার ছেলেবেলা’ (২০১৩) এবং ‘ছড়ায় ছড়ায়’ নামের একটি বই কিছুকাল আগে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রবন্ধ প্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ‘সংস্কৃতি : জাতীয় মুখশ্রী’ (২০০৬), ‘আলোর সন্ধানে দেশ’ (২০০৮), ‘সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি’ (২০০৮)।
‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন স্বশিক্ষিত নানী তাঁর জীবনে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর ভাষায়: ‘নজরুল ইসলামের প্রভাবে নানী ক্রমে প্রগতিমুখী হয়ে ওঠেন। … নানী বলতেন, সব ধর্মের একই বাণী। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। সৎ পথে চলা। কারো অনিষ্ট না করা।’(পৃ.২৫)। নানীর কাছেই তিনি ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘বাইবেল’, ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’এর কাহিনী শুনেছেন। এভাবে সকল ধর্মের প্রতি তাঁর সহনশীল মানসিকতা গড়ে ওঠে শৈশবেই। ফলে পরিণত বয়সে তার পক্ষে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন সহজ হয়েছে। তাই তিনি কোরবানীর পশুর পশে গিয়ে তার চোখের জল মুছে দিতেন। বড় হয়ে তিনি লেখেন: ‘আমরা যদি মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে, মানবতাবাদী শিক্ষাক্রমের সামাজিক পরিবেশ বদলাতে না পারি, তবে মানুষের ভেতরের পশুটাকে বধ করা সহজ হবে না’ (পৃ. ৩০)। তিনি বিশ্বাস করেন শিক্ষা-সংস্কৃতি-রুচি ও মূল্যবোধ সুষ্টির মাধ্যমে মানুষের ভেতরের পশুটিকে বধ করতে পারলেই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
তাঁর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি বায়ান্নোর একুশে ফেব্রæয়ারি রাতে রচিত ও বাইশে ফেব্রæয়ারি প্রকশিত হয়। পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করলে কবিতাটি হারিয়ে যায়। ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কবির স্মৃতি থেকে কবিতাটির কিছু অংশ উদ্ধার করেন। ১৯৮৬ সালে কবি বাংলা একাডেমির সম্মাননাসূচক ফেলোশিপ পেলে পর কবিতাটি ব্যাপকভাবে মিডিয়ার আলোচনায় আসে। জনাব মফিদুল হকের সৌজন্যে একটি ডায়রিতে লিখিত অবস্থায় কবিতাটির মূল অংশ পাওয়া যায়। ১৯৮৮ তে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান-রচিত ভূমিকাসহ ১৯৪৬ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে রচিত নির্বাচিত কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কাব্যগ্রন্থ। আরও পরে (১৯৯১) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক খুঁজে পান লিফলেট আকারে মুদ্রিত কবিতার কপি। এটি পুনরায় প্রকাশিত হয় ‘গরাদ ভাঙার সংগ্রামীরা জাগো (২০০৭) কাব্যগ্রন্থে। চৌধুরী জহুরুল হকের মতে: ‘কবিতাটি দীর্ঘ সতেরো পৃষ্ঠার নয়-১/৮ ডিমাই সাইজের মলাট সহ (২+৬) আট পৃষ্ঠার। কবিতাটি সতেরো পৃষ্ঠা বলে বারবার উচ্চ্বারিত হওয়ার কারণ বোধ হয় এই যে, হাতের লেখা পান্ডুলিপিটি হয়তো সতেরো পৃষ্ঠার ছিল।’ আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগে এই চট্টগ্রামের স›দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম কড়া ভাষায় বাংলাভাষা-বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি বিষোদগার করেন: ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী / সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি\’ তারপর কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী এ কবিতায় বাংলাভাষা-বিরোধীদের ফাঁসীর দাবি জানালেন। কবিতাটি প্রকাশের পর একুশের প্রথম কবিতার কবি বিশেষণে বিশেষিত হন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তবে নিজের আত্মজীবনী স্মৃতির সন্ধানেতে তিনি এ-সম্পর্কে লিখেছেন : ‘এই কবিতা মুহূর্তের সৃষ্টি নয়, এই কবিতা লিখতে আমার দশ বছর সময় লেগেছে। ’৪২ সালের ভারত-ছাড়ো আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে এর ব্যাপ্তি।’ এ বক্তব্যটা এই কবিকে বোঝার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বর্তমানে খন্ডিত আলোচানায় আগ্রহী আমরা সামগ্রিকভাবে না ভেবে খন্ডিত বিশেষণ দিয়ে বিরাটকে আমাদের সমপর্যায়ে এনে খাটো করি। এই যেমন, গত নভেম্বরে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এই কবিতাটির প্রসঙ্গে পত্রিকান্তরে লিখলেন: ‘এখানে একটি শব্দও আরবি, ফার্সি বা তৎসম শব্দ নেই।’ অথচ আমরা দেখি, রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়া তৎসম শব্দ, গজল ও শহীদ আরবি শব্দ, টেবিল ও লিংকন ইংরেজি শব্দ। কবি যখন লেখেন ‘খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে / ঝুলাবেই ঝুলাবে।’ তখন ফারসি, আরবি, খাঁটি বাংলা শব্দ আর তৎসম শব্দ এক পঙক্তিতেই অনায়াসে স্থান পায়। কেননা সকল শব্দ নিয়েই আমার প্রাণের ভাষা বাংলা। বিচিত্র সংস্কৃতির মিশ্রণেই আমার বাঙালি সংস্কৃতি; যার মূল কথা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য একথা যেনো আমরা ভুলে না যাই।
কর্মকৃতির জন্য ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে সম্মাননাসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ২০০১ সালে তাঁকে একুশে পদক ও সংবর্ধনা প্রদান করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া তিনি ঢাকা এবং চট্টগ্রামে স্বর্ণপদকসহ বহু সংবর্ধনা লাভ করেছেন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনার মশাল বয়ে গেছেন। ২০০৭ সালের প্রান্তিকে এসে ২৩ ডিসেম্বর ২০০৭, একাশি বছর বয়সে তিনি মাটি ও মানুষের মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। অবসান হয়েছে তাঁর বর্ণাঢ্য, কর্মময় ও বহুমাত্রিক-সংগ্রামী জীবনের। ২০০৯ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী তাঁর মেধা-প্রতিভা-শ্রম নিয়োজিত করেন সমাজ পরিবর্তনে ও মানবকল্যাণে। ফলে তাঁর পক্ষে সব সময় সৃষ্টিশীল থাকা সম্ভব হয়নি। মধ্য চল্লিশ থেকে মধ্য ষাট-যে দুই দশক জুড়ে মাহবুব উল আলম চৌধুরী সৃষ্টিতে ও সংগঠনে ব্যাপৃত ছিলেন তা ছিল বিচিত্র ঘটনায় বন্ধুর, অস্থির, অনিশ্চিত। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশত্যাগ, ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও রাজনীতির পাশাপাশি প্রগতিশীল সাম্যবাদী রাজনীতির বিভাজন ও বিপর্যয় তাঁর স্বপ্ন ও উদ্যমকে তছনছ করে দিতে উদ্যত হয়। তাই তিনি রাজনীতি, কর্মজগৎ, এমনকি লেখার জগৎ থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন এর ভাষায়: ‘এ তাঁর সন্ন্যাস নয়, অজ্ঞাতবাসও নয়, অভিমান ও ঔদাসীন্যের মিশ্রণ যেন।’ অবশ্য, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের অব্যবহিত পরে কিছুকাল চট্টগ্রামে একটি সংবাদপত্রের (দৈনিক স্বাধীনতা) সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক মন বসেনি, তাঁর ভেতরকার সৃষ্টিশীল ও কর্মজীবী সত্তাটি তেমনভাবে সাড়া দেয়নি। পঁচাত্তরের নারকীয় (১৫ই আগস্ট, সপরিবারে জাতির জনক হত্যাকান্ড) হত্যযজ্ঞের পরে ঢাকায় গিয়েও তিনি নিশ্চুপ, নিষ্ক্রিয়। অনেক পরে নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ও যুদ্ধাপরধীদের বিচারের আন্দোলনে তিনি আবার সক্রিয় হন কবিতায় ও শাণিত প্রবন্ধে। তবে ততদিনে চার দশকের বিরতি পড়ে গেছে। বার্ধক্যের ছাপ আড়াল করে তারুণ্যের অট্টহাসি আর অতোটা ফোটে না আগের মতো। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতিও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বক্তব্যে আর যেন স্বস্থি বোধ করে না। মাহবুবুল আলম চৌধুরীর বহুমাত্রিক চিন্তা-চেতনাও তাই আলোচনায় অতোটা আসে না। তবু আশার কথা, তরুণপ্রজন্মের কাছে মাহবুব উল আলম চৌধুরী বিস্মৃত নন। তাঁর কবিতা-কলাম, নাটক ও জীবন-সংগ্রাম আমাদের আলোর পথরেখা দেখাবে, মানব-মুক্তির প্রেরণা জোগাবে। আমদের স্মরণ করিয়ে দেবে ‘বাঙালির বীজমন্ত্র’ মানুষের জয়গান।