বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও আমাদের প্রস্তুতি

1349

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের সমার্থক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা যেমন প্রশ্নাতীত, ঠিক তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা একক ও অনন্য। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দল ও মতের অমিলে আমাদের ইতিহাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। স্বাধীনতার স্বপক্ষে ও বিপক্ষের মধ্যে তফাৎটি দিন দিন বাড়তে থাকে। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড। এরপর কয়েক বার সরকার বদল হয়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে শিশু হত্যা, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের রাজনীতি চির অবসানে শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যে শিশু অধিকার আইন বাস্তবায়ন করেছেন। মাদক, দুর্নীতি, পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা ও হত্যাকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসলে সামগ্রীকভাবে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। শেখ হাসিনার বয়সের সাথে সাথে চিন্তাধারার ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে এখন দুর্নীতি বিরোধী অভিযানটি ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শুধু নয় একজন সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে উনার সাহসী পদক্ষেপে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে তাতে নিজ দল ও নেতাদের মধ্যেও পরিবর্তন ঘটছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে যেই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। নিজের দল হোক, বিরোধী দল হোক, আপন হোক, পর হোক সবাইকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। উন্নয়নের সাথে সাথে শিক্ষাঙ্গন ও সামাজিক অস্থিরতার ফলে আমরা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করে সামগ্রীক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে শিক্ষাকে ধাপে ধাপে জাতীয়করণে আনার বিষয়টি ব্যাপক প্রসংসার দাবিদার। ক্যাসিনো, মাদক, সড়ক দুর্ঘটনার শুদ্ধি অভিযান আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে একজন সাহসী ও সৎ রাজনীতিবিদের মর্যাদা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে শিশুদের অধিকারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিনীত আহবান জানাচ্ছি। শেখ রাসেলের মত একটি নিষ্পাপ শিশু সেদিন বর্বর হত্যাকারীদের হাতে রেহায় পায়নি। রাসেল একটি প্রতীক। জাতির পিতার নিষ্পাপ শিশুপুত্র শেখ রাসেলের স্মৃতি সুরক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শিশুদের প্রতি দায়িত¦ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। শেখ রাসেল জীবন দিয়ে পৃথিবীর নিষ্ঠুর আচরণের জন্য প্রতিবাদ করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশের ইতিহাসে শুধু নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও এ হত্যাকাণ্ড বর্বরোচিত ও জঘন্যতম। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার নিশ্চিন্ন করতে শেখ রাসেলকে হত্যা করা হয়েছে। শিশু রাসেলকে যেভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা একজন বিবেকবান মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শেখ রাসেলের নিষ্পাপ দৃষ্টি ও নিথর দেহটিকে কেন্দ্র করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে বোধশক্তি জাগ্রত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চে শুরু হয়ে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। আগামী মার্চ ২০২০ থেকে প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর স্মরণে বক্তৃতার আয়োজন করা হবে। যে বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি আপামর জনসাধারণের মাঝে মুক্তির স্বাদ এনেছিলেন। আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় হচ্ছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান যৌথভাবে উদ্যাপন করবে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং বাংলাদেশসহ উদ্যাপন করবে। বিশ্বের ১৯৫ দেশে একত্রে উদ্যাপিত হবে মুজিববর্ষ। ইউনেস্কোর ৫০ তম অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। জন্মশত বার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশ্বনেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের নানান প্রান্তে বছরজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা করা হবে। জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের নেতাসহ কয়েকজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। তাদের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভূটানের রাজা জিগমে ওয়াং চুক, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, ইউনেস্কোর সাবেক মহাসচিব ইরিণা বুকোভো, আরবলীগের সাবেক মহাসচিব আমর মুসা। ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের দিন গণনা শুরু হবে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বিকেলে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শত শিশুর কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীতসহ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিফলন থাকবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কাজের দৃশ্যকল্প তুলে ধরে আগামী প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শিত করার চেষ্টা করা হবে। বিশে^র গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সম্মেলন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১২টি স্বল্পদৈর্ঘ্য, ১২টি তথ্যচিত্র এবং একটি ওয়েব সিরিজ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এই বই দুইটি দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটির একটি সংকলন বের করারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে ২০২০ সাল থেকে একটি পুরস্কার প্রবর্তন করতে যাচ্ছে ইউনেস্কো। গবেষণা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিকাশে তরুণদের উৎসাহিত করতে এ পুরস্কার দেওয়া হবে। ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর এই পুরস্কারের জন্য ইউনেস্কোকে অর্থ দেবে বাংলাদেশ। মুজিব বর্ষ উদ্যাপনকালে দেশজুড়ে নানা কর্মসূচি পালনের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন আরও ব্যাপক পরিসরে তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি হলে, একটি প্রতিবাদী চেতনা সকল অন্যায়-অত্যাচারকে প্রতিহত করতে অনুপ্রাণিত করবে। প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। শুধুমাত্র পালন ও স্মৃতিচারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই জন্মশতবার্ষিকী পালনের উদ্দেশ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে নিমন্ত্রণ করে বঙ্গবন্ধুর মহান রাজনৈতিক জীবনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তি নয়, বর্তমানে আমাদের দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা দেশগুলোর আমন্ত্রণের তালিকায় থাকা আন্তর্জাতিক নেতাদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, ভারতের কংগ্রেস পার্টির সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধি, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতা ও ভারতের উপ-প্রধানমন্ত্রী এল.কে.আদভানি, জার্মানির চ্যান্সেলর আঞ্জেলা মার্কেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডো, মালেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ প্রমুখ এই মহতী অনুষ্ঠানে একাধিক বিশ^নেতার উপস্থিতি আমাদের আয়োজনকে অলংকৃত করবে।
আমাদের মহান নেতাকে বিশ্ব দরবারে নন্দিত করবে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, দিল্লী, কলকাতা, বার্লিন, টোকিও সহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানাতে সাহায্য করবে। শুধুমাত্র বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালিদের অনুপ্রেরণা করবে না অনেক নাম না জানা অপরিচিত বিদেশি ভাই-বোনরাও আমাদেরকে জানতে ও বুঝতে পারবে। ফলে আমাদের প্রবাসী বাঙালি ভাই-বোনের সাথে সম্পর্কটা আরো জোরদার হবে। ১৭ই মার্চ একটি আনন্দের দিন, একটি প্রতিবাদী দিন আর এই দিনটি হোক সকল অন্যায় প্রতিহতের প্রতীক, একটি জাতির মুক্তির প্রতীক ও একটি দেশের আপামর জনসাধারণের উন্নয়নের শিখরে আরোহণের প্রতীক। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে সম্প্রতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে আন্তর্জাতিক স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
‘‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্মারকগ্রন্থ’’, আগরতলার কৃতী পুরুষ ড. দেবব্রত দেবরায় ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে ১০ মার্চ ২০১৯ তারিখে এর সূচনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আন্তর্জাতিক স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে আগরতলার মানুষ বাঙালি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের ঋণী করেছেন। বঙ্গবন্ধু উপাধির প্রস্তাবক শ্রদ্ধেয় রেজাউল হক চৌধুরী মোস্তাক তার লিখনীর মাধ্যমে ও উপস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মানুষের কাছে একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এই সাধারণ গুণাবলিই একদিন বঙ্গবন্ধুকে অসাধারণ করে তুলেছে।
মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালবাসার কথা সবসময় বঙ্গবন্ধুর আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে আছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নয়, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেও এই দিবসটিকে ঘিরে চলছে নানান আয়োজন। এই দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গান, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের দলিল হতে পারে। আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি শিক্ষক সমাজ এবং অন্যান্য পেশার মানুষগুলোও তাদের কর্মকাণ্ডে ও প্রচার-প্রচারণায় বঙ্গবন্ধুকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। একটি গণ্ডির সীমাবদ্ধ না রেখে অসীমের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। এই হোক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের মূল লক্ষ্য।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, কলামিস্ট