‘পরিকল্পিত হত্যা’ বিশ্বাস করেননি সগিরার স্বামীও

37

তিন দশক আগে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় সগিরা মোর্শেদ সালাম খুনকে তখনকার গণমাধ্যমে পারিবারিক দ্বন্ধের জেরে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে বলা হলেও তা বিশ্বাস করতে পারেননি নিহতের স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী। ওই ঘটনায় নিজের ভাই ও ভাবিসহ চারজনকে আসামি করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর গতকাল শুক্রবার তিনি এ প্রতিক্রিয়া জানান।
আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমার স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমার ভাই, ভাইয়ের বউ, এভাবে স্বজনরা জড়িত; তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। বুঝব কিভাবে? ভাইদের মধ্যে কখনও টাকা নিয়ে দ্বন্ধ হয়নি। আড়াই মাস আগে যখন ১৬৪ জবানবন্দি দিল, তখনই বুঝলাম তারা জড়িত। সত্যিই ভাবতে কষ্ট ও অবাক লাগে। এই সাংসারিক তুচ্ছ ঘটনায় একটি খুনের মত ঘটনা ঘটতে পারে!’
ওই সময় বাংলার বাণী পত্রিকার এক প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একবার লিখেছিল, ‘এটি ছিনতাই নয়, পারিবারিক কোন্দলে হত্যাকাÐ’। ভাবতাম পত্রিকায় অতিরঞ্জিত লিখেছে। কিন্তু এখন বুঝলাম সেইদিন পত্রিকায় সঠিক লিখেছিল’।
এই প্রসঙ্গে হত্যার ঘটনায় ভাড়াটে খুনি হিসেবে সম্প্রতি পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার মারুফ রেজার মামা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসান তাদের বাসায় পুলিশ নিয়ে এসে যেসব কথা বলেছিলেন তার মধ্যে সন্দেহজনক ইঙ্গিত ছিল বলে এখন মনে করছেন সত্তরোর্ধ্ব এই ব্যক্তি। সালাম বলেন, ‘আমার স্ত্রী খুনের দুইদিন পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাসায় এসে আমার ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে তখনকার রমনা থানার ওসি রফিককে বলেছিল, রফিক তুমি আসামিদের ধরতে পারবে না? রফিক জি স্যার বলেছিল ‘তিন বার। তিন বার জি স্যার বলার পেছনে যে অন্য কিছু লুকিয়ে ছিল তা সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ বুঝতে পারছি। যেসময় মাহমুদুল হাসান আমার বাসায়, তখন তার ভাগ্নে মারুফ রেজাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে’।
সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাÐে জড়িত হিসেবে তার ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০), হাসানের স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন (৬৪), শাহিনের ভাই আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান (৫৯) ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে মারুফ রেজার (৫৯) বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই। খবর বিডিনিউজের
এর আগে ধানমÐিতে পিবিআই সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার হলেন, এরা সবাই হত্যাকাÐে নিজেদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বড় জায়ের ঈর্ষার কারণে খুন হয়েছিলেন সগিরা মোর্শেদ। তাকে খুন করতে ২৫ হাজার টাকায় আসামি মারুফ রেজাকে ভাড়া করা হয়।
ওই সময়ে প্রকাশিত দৈনিক জনতা, বাংলার বাণী ও নিউ ন্যাশন পত্রিকার খবর দেখিয়ে বনজ কুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনাদের বড় ভাইয়েরা সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাÐকে একটি ‘পরিকল্পিত হত্যাকাÐ’ বলেছিল। আপনাদের বড় ভাইয়ের লেখা আজ সত্যি হলো। ৩১ বছর পর আমরা (পিবিআই) প্রমাণ করেছি যে, সগিরা মোর্শেদ পরিকল্পিত হত্যাকাÐের শিকার’।
যেভাবে হত্যা করা হয় সগিরা মোর্শেদকে
আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকালে স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে রিকশায় করে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে যাওয়ার সময় সগিরা মোর্শেদের পথ আটকান মটরসাইকেল আরোহী মারুফ ও রেজওয়ান। হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার পর তার হাতের বালা নিতে উদ্যত হলে রেজওয়ানকে চিনে ফেলার কথা বলেন সগিরা, তারপরই তার বুকে গুলি চালিয়ে দেন মারুফ।
এখনকার আবাসন ব্যবসায়ী বেইলি রোডের বাসিন্দা মারুফ রেজা ওই সময়ই গ্রেপ্তার হলেও ক্ষমকার জোরে তার নাম বাদ দিয়ে মন্টু নামে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ।
অপকৌশল পদে পদে
সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে প্রতি পদে পদে অপকৌশল দেখতে পেয়েছেন বলে জানান পিবিআই প্রধান। তিনি বলেন, সেই সময় মারুফ রেজাকে গ্রেপ্তারের পর তার বয়স ১৮ বছরের কম দেখানো হয়েছিল কৌশলে। কিন্তু সেই সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর ৪ মাস ১৫ দিন। মন্টুকে আসামি করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার পর মামলাটি যখন চলছিল, তখনই তৃতীয় এক ব্যক্তি আদালতে মামলায় স্থগিতাদেশের আবেদন করেন। এই তৃতীয় ব্যক্তির খোঁজ নিয়ে জানা যায় তিনি ছিলেন মারুফ রেজা। এই সূত্র ধরেই মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়।
মারুফের করা আবেদনে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাই কোর্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। পরের বছর ২৭ আগস্ট জারি করা ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আরেকটি আদেশ দেয় হাই কোর্ট।
এবিষয়টি নজরে এলে ২৮ বছর আগের ওই রুল নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। গত বছর জুনে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ মামলা স্থগিতে মারুফ রেজার ওই আবেদন খারিজ করে দিয়ে পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।
তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে প্রথমে মামলার বাদী সগিরা মোর্শেদের স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পিবিআই। অনেক চেষ্টার পর সগিরাকে বহনকারী রিকশাচালক সালাম মোল্লার সন্ধান পায় মাদারীপুরে। বনজ কুমার বলেন, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর ছয় মাসে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের মধ্যে সালাম মোল্লাসহ আটজনকে অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয়েছে। সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাÐের পর এই ৩১ বছরে ২৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৫ জন। একজনের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু মামলা স্থগিত থাকায় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়’।