পতিত ৪৩ লাখ হেক্টর জমির ভবিষ্যৎ কী?

46

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতি ইঞ্চি পতিত জমিকে চাষের আওতায় এনে উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি পড়ে না থাকে। বর্তমানে দেশে পতিত জমির পরিমাণ ৪৩ লাখ ৯ হাজার ৩৩১ হেক্টর। তবে এই বিশাল পরিমাণের অনাবাদি জমিকে কীভাবে আবাদের আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে মানুষকে উৎসাহিত করা ছাড়া সরকারের তথা কৃষি বা ভূমি মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট আর কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী, কোনো জমি তিন বছর পতিত রাখলে সেই জমিকে স্থানীয় প্রশাসন খাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতা রাখে। তবে সরকার এই মুহূর্তে সেদিকে যেতে চাচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কোনো কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলেও আভাস দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি পড়ে না থাকে, সে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষি জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে গত ১৬ অক্টোবর কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা এক ইঞ্চি জমিও কেউ ফেলে রাখবেন না। গাছ লাগান, ফল লাগান, তরিতরকারি লাগান। যে যা পারেন কিছু লাগিয়ে উৎপাদন বাড়ান। যখনই করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে, তখনই আমরা সবথেকে গুরুত্ব দিয়েছি খাদ্য উৎপাদনে। আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। খাদ্যের নিশ্চয়তা রাখতে হবে’।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পতিত জমির মোট পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার শতক বা ৪৩ লাখ ৯৩৩১ হেক্টর (২৪৭ শতকে এক হেক্টর)। বিবিএস এর প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশে মোট ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ২২৬ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার শতক। পরিবারপ্রতি জমির পরিমাণ প্রায় ৮২ শতক। এসব জমির মধ্যে বসতবাড়ি, পুকুর, স্থায়ী ফসলি জমি, অস্থায়ী ফসলি জমির পাশাপাশি পতিত জমিও রয়েছে। এর মধ্যে পতিত জমি রয়েছে দুই ধরনের। প্রথমত অস্থায়ী পতিত এবং স্থায়ী পতিত জমি, যার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার শতক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্থায়ী পতিত জমি বলতে যেসব জমিতে চলতি বছরে আবাদ বা কোনো ধরনের শস্য উৎপাদন হয়নি, কিন্তু তার আগের বছরে জমিটিতে আবাদ হয়েছে। এমন জমির পরিমাণ প্রায় এক কোটি ৫৩ লাখ ৫৫ হাজার শতক। পরিবারপ্রতি এ ধরনের জমি রয়েছে গড়ে প্রায় এক শতক। অন্যদিকে কখনই কোনো ধরনের আবাদ হয়নি বা শস্য উৎপাদন হয়নি এমন জমিকে বলা হয় স্থায়ী পতিত জমি, দেশে যার পরিমাণ প্রায় ৯ কোটি ৩১ লাখ ৫৯ হাজার শতক। পরিবারপ্রতি এ ধরনের পতিত জমি রয়েছে গড়ে প্রায় তিন শতক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পতিত জমির বেশিরভাগ মালিক এসব জমির কাছাকাছি বসবাস করেন না। তারা চাকরির কারণে হোক, আর ব্যবসার কারণেই হোক, তারা নিজের বসতবাড়ি বা নিজের মালিকানাধীন জমি থেকে দূরে বসবাস করেন। ফলে এসব জমির বেশিরভাগই সারা বছর অনাবাদি রয়ে যায়। কিছু জমি মাঝেমধ্যে চাষাবাদ হলেও তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার সোহাগদল গ্রামের বাসিন্দা গোলাম রব্বানী চাকরির সুবাদে পরিবার পরিজন নিয়ে রাজধানীতে বসবাস করেন। গ্রামের বাড়িতে তার পৈতৃক সম্পত্তির পাশাপাশি নিজের কেনা জমিও রয়েছে। যা তিনি সীমানা দেয়াল দিয়ে রেখেছেন। এসব জমি সারাবছরই আনাবাদি থাকে। কারণ জানতে চাইলে গোলাম রব্বানী জানিয়েছেন, ‘বাড়িতে আমার এসব জমি দেখাশোনা করার কেউ নাই। ভাইবোন সবাই রাজধানী ঢাকায় বসবাস করছি। বাড়িতে চাচাতো ভাইয়েরা রয়েছেন। তাদের এ জমি চাষাবাদের দায়িত্ব দিলে এক সময় পুরো জমি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এমন আশঙ্কায় কাউকে চাষাবাদ করতে দেইনি’।
গোলাম রব্বানীর মতো অনেকেই জীবিকার প্রয়োজনে বসতবাড়ি ছেড়ে কেউ রাজধানী ঢাকায় বা অন্য কোনো জেলায় গিয়ে বসবাস করছেন। যাদের নিজস্ব পৈতৃক সম্পত্তি বা নিজের কেনা সম্পত্তি বছরের পর বছর অনাবাদি রয়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পরেও এসব জমি এবছরও অনাবাদি থাকতে পারে। কারণ এসব জমি আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে মানুষকে অনুরোধ-পরামর্শ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই আপাতত করছে না সরকার তথা কৃষি ও ভূমি মন্ত্রণালয়।
এসব জমি আবাদের আওতায় আনতে সরকার কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেবে কিনা জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী সচিব মোহম্মদ নাসিরুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘জমির মালিককে তার জমি চাষাবাদের জন্য অনুরোধ করা যায়, উৎসাহ দেওয়া যায়, সহযোগিতার প্রয়োজন হলে সহযোগিতাও করা যায়। কিন্তু জোর করে কি কিছু করা যায়? তিনি তার জমি চাষাবাদের জন্য কাকে দেবেন, সেটি তার সিদ্ধান্ত। সেখানে সরকারের পক্ষে জোর করার তো কিছু নাই। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনতে সব ধরনের সহযোগিতার জন্য সরকার তথা কৃষি বিভাগের উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসব পতিত জমির মালিকেরা নিশ্চয়ই তাদের অব্যবহৃত জমি চাষাবাদের জন্য কাউকে না কাউকে দায়িত্ব দেবেন এটি আমাদের বিশ্বাস। আমরা এও বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর এবছর কোনো জমি অব্যবহৃত পড়ে থাকবে না’।
তিনি জানান, ‘১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে কেউ যাতে নিজের জমি আনাবাদি না রাখেন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে। কোনো জমি তিন বছর পতিত রাখলে প্রজাস্বত্ব আইনে সেই জমিকে সরকার তথা স্থানীয় প্রশাসন খাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। আমরা এই মুহূর্তে সেই কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে যেতে চাই না। কৃষকদের সরকারি প্রণোদনা কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, যাতে প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আসে। আমরা চাই না কোনো জমি অনাবাদি থাকুক’।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী জানিয়েছেন, ‘জমি চাষবাদের আওতায় আনা না আনার বিষয়টি দেখভাল করে কৃষি মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাজ খুব বেশি নাই। তার পরেও কোনো অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে যদি কোনো কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে ওইসব কাগজপত্র দ্রুত সরবরাহ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। আমরাও আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সবাইকে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য সব ধরনের উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে যাচ্ছি’।
উল্লেখ্য, বিবিএসের সর্বশেষ দেওয়া তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে বসতবাড়ি রয়েছে ২১ কোটি ২৯ লাখ ৬৩ হাজার শতক। পরিবারপ্রতি বসতবাড়ি জমির পরিমাণ প্রায় আট শতক। অন্যদিকে দেশে মোট পুকুর রয়েছে পাঁচ কোটি ৫৪ লাখ ৮১ হাজার শতক জমিতে। পরিবারপ্রতি পুকুরের জমির পরিমাণ প্রায় দুই শতক। স্থায়ী ফসল (যেমন ফল, বাগান) বা জীবনকাল এক বছরের বেশি এমন ফসলের আবাদি জমির পরিমাণ ১২ কোটি ৩৪ লাখ ৩৮ হাজার শতক। অন্যদিকে অস্থায়ী ফসলি (জীবনকাল এক বছরের নিচে এমন) জমির পরিমাণ ১৭৬ কোটি ৪৭ লাখ ৭৭ হাজার শতক। মূলত নিয়মিত যেসব কৃষিশস্য বা ফসল আবাদ করা হয় এমন জমিগুলোকেই অস্থায়ী ফসলি জমি বলা হয়। পরিবারপ্রতি এমন জমির পরিমাণ প্রায় ৬৪ শতক। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
বিবিএস জানিয়েছে, দেশে চাষযোগ্য ফসলি জমি এখন প্রায় ১৭৮ কোটি ১ লাখ ৩৩ হাজার শতক। ফলে পরিবারপ্রতি ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৬৫ শতক। এর মধ্যে এক ফসলি জমি এখনও ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার শতক। অন্যদিকে দোফসলি জমির পরিমাণ ১০৫ কোটি ৫৬ লাখ ১১ হাজার শতক। এছাড়া তিন ফসলি জমি রয়েছে ২০ কোটি ৬২ লাখ শতক। চার ফসলি জমি রয়েছে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার শতক।