“কারাগারের রোজনামচা” পাঠের অনুভূতি …

162

বিশ্ব সমাদৃত সংগ্রামী মহান নেতা বাঙালি জাতির অস্তিত্ব ও বাংলাদেশ সৃষ্টির অনন্য দিক নির্দেশক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক মানবদরদীর উচ্চমার্গী নাম। তিনি একাধারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতিসত্তার কালজয়ী ঐতিহাসিক শোষিত- বঞ্চিত,নির্যাতিত – নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন পুরুষ। যাকে আমরা বঙ্গবন্ধু নামে চিনি। এই বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের মানুষ, কত মহৎ ও দেশপ্রেমিক তাকে না পড়লে বুঝা যাবে না। তাঁর ইতিহাস পড়লে যে-কেউ চোখের জলে ভেসে যাবে যে তিনি বাংলার মানুষের জন্য কত কষ্ট করেছেন, কত অবহেলা ও নির্যাতন করেছেন। ১৯৪৭ সালে হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মূল অভ্যুদয় যা পরর্বুী তৎকালীন পাকিস্তানের অধীনে পূর্ব পাকিস্তান জনগণের সংগ্রাম ও স্বাধীনতা ইতিহাস। দীর্ঘ ২৩ বছর তৎকালীন পাকিস্তানিদের শাসন – শোষণ ও লাঞ্জনা- গঞ্জনা সয়েছিলেন এই অঞ্চলের মানুষ। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ওপর যে চরম অবজ্ঞা করেছেন তাঁর প্রতিবাদে সিংহের মতো গর্জে ওঠেছিল বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠ। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরলস সাধনা ও দৃঢ়তা দিয়ে হাসিল করে হাজার বাঙালি জাতি নারী সম্ভ্রমহারা ও পুরুষের অস্তিত্ব। এ কাজটি করতে গিয়ে আপোষহীন নেতা কে তিলে তিলে ভোগ হয়েছে বিভিন্ন অপমান,নির্যাতন ও কারাভোগ। অসহনীয় কারাভোগের নিত্যকার কষ্ট, হাসি, কান্না, দুঃখ সবই তিনি লিখেছেন তাঁর কলমের ডগায়। তা আজ বাঙালি হাতে পেয়েছেন মহাকাব্যরূপে – যার নাম “কারাগারের রোজনামচা”। তবে বঙ্গবন্ধু ১৯৩৮ সালে ছাত্র অবস্থায় জীবনের প্রথম জেল হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর ৫৪ জীবনে প্রথম ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তার জীবনের চতুর্থাংশ।বঙ্গবন্ধু তার জেল জীবনের সমস্ত ইতিহাস দিনলিপি লিখে গেছেন তাঁর বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারেররোজনামচায়। আজ আমি ক্ষুদ্র মেধায় তাঁর বই “কারাগারের রোজনামচা” থেকে দু কলম তুলে ধরবো।যদি ভুল ত্রুটি হয় ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
জেল জীবন যে কত কষ্টের তা বর্ণনা করেছেন খুব অনুভূতির গভীর থেকে। কত কষ্টের বহিঃপ্রকাশ করলে যে এমন বাক্য তিনি লিখতেন পারেন। বাঙালি ক্ষমা পাবে তো?
(জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই – তারা জানে না জেল কি জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টা। জনসাধারণ মনে করে চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে সমস্ত কয়েদি এক সাথে থাকে তাহা নয়।জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে। (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা /২৭)
কারাগার একটি বিচিত্র দুনিয়া। এই দুনিয়ায় মানুষ গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, মেশিন হয়ে যায়। জাতির পিতা বিনাদোষে কতবার খেটেছে তার সেই মর্মস্পর্শ বাণীগুলো লিখেছেন -কারাগারে রোজনামচা বইটিতে-
“আমি পাঁচবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদÐও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। এরপরও তিনি অনন্যা কয়েদিদের জন্য ব্যথিত হয়েছেন, চিন্তিত হয়েছে ।কয়েদিদের এক সেলে কখনো দুজন রাখে না কারণ ওরা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। জেলখানার ভেতর সবকিছু থাকে, তবে ওখানে যতরকম কাজ আছে কয়েদিদের করতে হয় আবার কারো কারো ভাল কাজের জন্য প্রমোশনও হয়। আমাদের বঙ্গবন্ধু খুব বিচক্ষণ ও খুব মানবদরদী মানুষ। তাঁর চোখে যা যা পড়েছে প্রতিটি বিচরণ নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন “কারাগারের রোজনামচা ”। যেমন – একজন কয়েদির কয়েকটি চুরি মামলায় জেল হয়। গ্রামের মানুষ তাকে সবাই খারাপ চোখে দেখত। ঐ চোর কয়েদি জেলখানায় এসে রাজা বনে যায়। তাকে কয়েকজন কয়েদিদের ভার দেওয়া হলে সে খুশি আত্মহারা হয়ে তার স্ত্রীকে চিঠি লিখে – আল্লাহ্ আমাকে প্রতিপত্তি ও সম্মান দুটো দিয়েছে। সুতরাং আমি বেশ ভাল আছি, তুমি চিন্তা করো না।
ক্ষণজন্মা মানবদরদী বঙ্গবন্ধু বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৪ বছর। এই অল্প জীবনের এই মানুষটির এক যুগ কেটেছে কারাগারে আবদ্ধ জীবনে। সেই জীবনে বসেও তিনি রীতিমতো সাঘি্যুচর্চা করেছেন। যা বাংলার মানুষকে আরও ঋণী করেছেন। তাঁর মাধুর্য ও বাক্য বিন্যাস সুনিপুণ। তাঁর দ্বিতীয়গ্রন্থের পড়লে সাধারণ মানুষ জেলখানার বিভিন্ন নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারবে। জেলখানার ভেতরে নিয়মের নানা রকম দফা আছে। যেমন, রাইটার দফা, চৌকি দফা, জলভরি দফা, ঝাড়ু দফা, বন্দুক দফা, পাগল দফা, শয়তানের কল, ডালচাকি দফা, ছোকড়া দফা ইত্যাদি। এই দফাগুলোর ভেতরে বিবরণ যেমন রসাত্মক তেমন জেল জীবনের একটি অংশও। (কারাগারের রোজনামচা/ পৃষ্ঠা / ৩১)
১৯৫০ সালে সমস্ত রাজবন্দীরা প্রায় ৬০ দিনের অনশন করে কিছুটা ফেলেও পরে তা আর পাওয়া যায়নি। তাদেরকে এক জেল থেকে অন্য জেলে চালান দিলে ইংরেজ আমলের কারণে খাবার ও থাকার ব্যবস্থা মোটামুটি ভাল ছিল।পরিবার – পরিজন আসতে পারতো এবং গ্রেট করে খাবার দিত। গ্রেট ওয়ান যারা তাদের রোজ ২ ছটাক মাছ,সকালে ২ টুকরা রুটি আর চা। মাখন, ডিম কিছুই দেওয়া হতো না ১৯৫২ সালের কথা। তখন তরকারিও দেওয়া হতো না। যারা ডিভিশন কয়েদি তারাও সকালে রুটির সাথে মাখন পেত, কিন্তু আমাদের দেওয়া হতো না। আহা, আমাদের বাংলা সৃষ্টি মুকুট, অনাহারে ও অর্ধহারে বন্দী অতিবাঘিু করেছিলেন। সত্যি ভাবতে চোখে জল আসে। আরও দুঃখজনক ব্যাপার বঙ্গবন্ধুর বাবা-মা ও স্ত্রীর পাঠানো চিঠির অক্ষর কালো কালি দিয়ে মুছে দিত। সেই অভিমানে ১৯৪৯ সাল ৫২ সাল পর্যন্ত তাঁর স্ত্রীকে আসা নিষেধ করে দিলেন। ঐ সময় (১৯৪৯- ৫০) সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারণে বঙ্গবন্ধু, শামসুল হক সাহেব, ফজলুল হক ও আব্দুর রউফের বিরুদ্ধে মামলা করে। সেটি লিয়াকত আলী খানের সভার শোভা যাত্রায় লাঠি চার্জ করে ভেঙ্গে উনাদের গেপ্তার করেন। অনেকেই ছেড়ে দিলে তিনজনকে রাজনৈতিক বন্দি করেন। বিনা বিচারে বন্দীসহ তিনমাস সশ্রম কারাদÐ দেওয়া হয়। “কারাগারের রোজনামচা” গ্রন্থটি পড়লে এই রকম অসংখ্য ঘটনা ও নির্মম অমানবিক আচরণ সম্পর্কে জানাবে। বঙ্গবন্ধু জেলে বসে সবসময় পড়াশোনা করতেন। আর তার সাথে খবরের কাগজও। বাঙালি লেখকদের তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শওকত ওসমান ও শহীদুল্লাহ্ কায়সার সহ আরও অনেক প্রমুখ প্রিয় ছিল। তিনি বাঙালি জাতিকে তিলে তিলে ঋণী করেছেন। তিনি জানতেন বাঙালি পরশ্রীকাতর ও বিশ্বাসঘাতক তবুও তিনি ওসব করে দেশের অকাতরে নিঃশেষ করলেন।বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনৈতিক মহানায়ক ও কীর্তিমান উজ্জ্বল এক এ
সোপান। কালে কালে বাঙালিকে তাঁর কাছে মাথা করেই বাঁচতে হবে। আগামী ১৫ আগষ্ট তাঁর দিবস। তাঁর বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।