করোনাভাইরাস পরিশুদ্ধ সমাজ-পরিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিধ্বনি

61

রেজা মুজাম্মেল

দূষণ, প্রকৃতিবিনাশী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পাহাড় কাটা, পাহড় দখল, প্রকৃতিকে লুণ্ঠন, প্রকৃতির প্রতি বিরুদ্ধাচরণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, ধুলাবালির অত্যাচার, পরিবেশ বিপর্যয়, নিজের স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার, ইচ্ছামত খাল-নদী দখল ও দূষণ, বন কেটে উজাড় করা, প্রাকৃতিক প্রাণী নির্মূল, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিরক্ত করা- এসব দেশের নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। প্রতিনিয়তই এসব ঘটনা ঘটে চলেছে। কখনো এক মুহ‚র্তের জন্যও থেমে থাকে না এসব ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ’ কাজ। এ নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিতই খবরের শিরোনাম হয়। দখল-দূষণের ঘটনা, পরিবেশ বিপর্যয়-বিধ্বংসী আচরণের আলোচনা-সমালোচনা সবই হয়। কিন্তু ফলাফল ‘যাহা বায়ান্ন তাহা তেপ্পান্নর’ মতই। পরিবেশ প্রকৃতি বিধ্বংসীরা তার কাজ সে করেই যাচ্ছে। কোনো দিকেই এতটুকু ভ্রæক্ষেপ করার ফুরসত নেই তার বা তাদের। এর চরম খেসারত হিসাবে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের নেতিবাচক ফল কি তা আজ গোটা পৃথিবীবাসীর জানা। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে জাতি হিসাবে আমাদের সবাইকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের খেসারত দিতে হচ্ছে এবং তা হয়তো নিজের অজান্তেই, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। মানুষ প্রকৃতিকে বিরক্ত করায় সময়ের বিবর্তনে প্রকৃতিও আজ মানুষের সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করছে। কারণ আগ্রাসী তাড়নায় মানুষ বুদ্ধি ও বাহুবলে প্রকৃতিকে শোষণ ও লুণ্ঠন করেই যাচ্ছে। বায়ু, পানি, মাটি, শব্দ দূষণ, খাল-নদী-নালা জলাশয় দখল ও দূষণ, ভরাট, বন সাবাড় ও পাহাড় কেটে পরিবেশ-প্রকৃতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দুই. এখন চলছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ। এতদিন পৃথিবীবাসী প্রকৃতিকে শোষণ করেছে। এখন প্রকৃতিই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অদৃশ্য একটি ভাইরাস পৃথিবীর সকল মানুষের জীবনাচারে পরিবর্তন এনেছে। বলা যায়, প্রকৃতির আরেক মহামারিতে মানুষকে তার আচরণ পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। করোনার প্রাদুভাবে চলছে সাধারণ ছুটি। সীমিত আকারে চলছে শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন বন্ধ। নেই কলকারখানা ও গণপরিবহনের বিষাক্ত কালো ধোয়া। ফলে প্রকৃতির চিরচেনা রূপে ফেরার একটা মোক্ষম সুযোগ হয়েছে। কারণ করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা কিংবা এড়াতে মানুষ তাদের প্রতিদিনকার নিজ নিজ অভ্যাস, আচরণ এবং স্বভাবসুলভ কাজগুলোতে পরিবর্তন আনছে। নানাভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশে এর ইতিবাচক সু² প্রভাব পড়ছে। প্রাণঘাতী মহামারির থাবা যখন বিশ্বজুড়ে, তখন বিপরীত চিত্র প্রকৃতিতে। সবুজে ফিরছে নগর, প্রকৃতি। ঝকঝকে নীল আকাশ। আপন রূপে জাগছে প্রকৃতি। সাজছে নয়নাভিরাম অবয়বে। নগরে সজীব নিশ্বাস নিচ্ছেন মানুষ। লোকালয়ে ফিরছে বিরল পাখি-কীটপতঙ্গ। প্রকৃতির দখলে আসছে প্রাকৃতিক সম্পদ। গাছ রাঙাচ্ছে নতুন ফুলে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের প্রকৃতি যেন ফিরে পেয়েছে আপন প্রাণ। ডালপালায় মেলতে শুরু করেছে লতাপাতা। সমুদ্রতীরে দেখা যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুক-ঝিনুকের বিচরণ। প্রাণ ফিরে পেয়েছে সৈকতের মলিন গাছগুলো। নগরে সড়কের পাশের গাছগুলোতে মেলেছে সবুজ কচিপাতা। উড়ছে রং-বেরঙের প্রজাপতি। বাতাসে নেই ভারী সিসা। ফলে পরিশুদ্ধ পরিবেশ-প্রকৃতি তৈরির সুযোগ হয়েছে। মহামারিটি মানুষকে তার আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য করেছে। ফলে এর সূ² প্রভাব পড়ছে কার্বন নিঃসরণ কমানোর মতো পরিবেশ বাঁচানোর পদক্ষেপগুলোয়। তবে প্রশ্ন হলো- খুব কম সময়ের ব্যবধানে মানুষের মধ্যে অনেক কিছুর আমূল পরিবর্তন হয়েছে, এ পরিবর্তন কতদিন স্থায়ী হবে? করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে মানুষ আবারো অতীতের অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি করবে না তো? পৃথিবীবাসী যদি এই করোনা থেকে শিক্ষা নিতে না পারে তাহলে এর খেসারত সবাইকেই দিতে হবে, যেমনটা বর্তমানে আমরা দিচ্ছি। তাই পরিবেশ নিয়ে সচেতন হওয়া, পরিবেশ নিয়ে ভাবা, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা নিয়ে চিন্তা করা, পরিবেশের বিপর্যয় রোধে উদ্যোগ নেয়া- এসব নিয়ে পরিকল্পনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পৃথিবীবাসীর চোখে আঙুল দিয়ে এসব দেখিয়ে দিয়েছে। পরিশুদ্ধ সমাজ ও পরিবেশ গঠনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এখনই।
তিন. জলবাযু পরিবর্তনের মত বৈশ্বিক সমস্যা করোনাভাইরাস সংক্রমণকে প্রভাবিত করছে কিনা এমন প্রশ্নও সামনে এসেছে। এ নিয়ে হচ্ছে তাত্তি¡ক আলোচনা ও গবেষণা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালযরে সেন্টার ফর ক্লাইমেট, হেলথ এবং গেøাবাল এনভাযরনমেন্টের অন্তর্বতী পরিচালক ডা. অ্যারন বার্নস্টেইন বলছেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বনাঞ্চল এবং সমুদ্রের ছোট ও বড় প্রাণীগুলো উত্তাপ থেকে বাঁচতে মেরুর দিকে এগিয়ে যায়। প্রাণিগুলো তাদের স্বভাব বদলে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং এটি রোগ জীবাণুদের জন্য নতুন হোস্টে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে।’ বার্ণ স্টেইন মনে করেন, ‘মহামারীর ঝুঁকি বেড়ে যাওয়াটা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম মূল কারণ। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রাণীরা তাদের আবাসস্থল বদলাতে বাধ্য হচ্ছে।’ তাঁর মতে, ‘নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে প্রাণীরা খাপ খাওয়াতে গিয়ে স্থানীয় প্রাণীদের সংস্পর্শে আসছে, ছড়াচ্ছে ভাইরাস, সংক্রমিত হচ্ছে প্রাণী থেকে মানুষে।’ সুতারাং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টাও কোনো মতেই অবহেলা করার নয়। অন্যদিকে, দূষণমুক্ত পরিবেশ মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দেশে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমÐলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরের বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর ৭০টি স্থানের বায়ু চারবার পর্যবেক্ষণ করে তথ্য পেয়েছে যে, ঢাকা শহরের বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। আমাদের পরিবেশের জন্য আরেক অভিশাপ গণপরিবহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। পরিবেশ অধিদফতরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের তথ্য মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের বিরাট একটি অংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। এসব মোটরযান থেকে ক্ষতিকর বস্তুকণা (কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং ওজোন) নির্গত হয়। ফলে দূষণ করে পরিবেশ।
চার. করোনাভাইরাস মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচারে পরিবর্তন এনেছে। শুদ্ধাচার শিখিয়েছে। শিক্ষা দিয়েছে মানকিতার। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অভ্যস্ত করছে। নৈতিকতার পাঠ দিয়েছে। অসত্য-অনৈতকতা পরিহারের বার্তা দিয়েছে। শিক্ষা দিয়েছে প্রকৃতি-পরিবেশকে বিরক্ত না করার। অনিয়ম-দুর্নীতি ত্যাগ করতে তাগাদা দিয়েছে। এসব শিক্ষা, বার্তা ও অভ্যস চর্চা পরিশুদ্ধ পরিবার, সমাজ এবং পরিবেশ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। খুব কম সময়ের মধ্যে দ্রæত পরিবর্তন হওয়া অভ্যাসগুলো যদি ধরে রাখা যায়, নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে যদি পরিশুদ্ধ জীবনের চর্চা করা যায়, তাহলে করোনা পরবর্তী একটি সুন্দর, সত্য, নির্মল, বিশুদ্ধ এবং পরিশুদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার আশা করা যায়। এখন থেকেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পরিশুদ্ধ পরিবার-সমাজ এবং পরিবেশ প্রতিষ্ঠার। সময় এসেছে পরিবর্তিত জীবনাচারে অভ্যস্ত হওয়ার। পরিশুদ্ধ পরিবার মানে পরিশুদ্ধ সমাজ। পরিশুদ্ধ সমাজেই নিরাপদ থাকে প্রকৃতি-প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাই পরিশুদ্ধ পরিবার-সমাজ প্রতিষ্ঠা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং প্রকৃতিকে বাঁচাতে পরিবর্তিত জীবনাচারকে স্থায়ী রূপ দেওয়া জরুরি। তা চর্চা করতে হবে এখন থেকেই। তবেই বাঁচবে পরিবেশ। রক্ষা পাবে প্রকৃতি। সবুজে সাজবে পৃথিবী। মুক্ত আঙিনায় নিশ্বাস ফেলবে পৃথিবীবাসী।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী