করোনাদের গল্প বলি শোনো

86

আকতার কামাল চৌধুরী

মধ্যরাতে উঠে দেখি, পায়ের দিকে দুটি মশা রক্ত খেয়ে লাল হয়ে আছে। নড়ার শক্তি নেই। আঙ্গুলে শুধু টেপা দিলাম। ল্যাপ্টে গেল আমার চামড়ার সাথে। শরীর থেকে বের হয়ে গেল সমস্ত রক্ত। খুশী আমি। নিজের রক্ত নিজেই দেখলাম। মনুষ্যজাতির একমাত্র শক্রকে আজ নিজ হাতেই খতম করে দিলাম। মানুষ্যজাতি আজ থেকে নিরাপদ !
এখন উল্টো করে ভাবি। এ দুটি মশার অপরাধ কী ? ভরাপেটে এদের মেরে রক্তাক্ত করে কীসের বীরত্ব দেখালাম? আমাকে নিরাপদ রাখাই কি বীরত্ব ? প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এরা অন্নের খোঁজে বের হয়েছে। প্রকৃতিতে এদের বাঁচতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টি করতে হবে। এই অমোঘ নিয়ম মানতে স্বজাতির সাথে যৌন সঙ্গম করতে হবে। তাই তার প্রয়োজন প্রচুর প্রোটিনের। এরজন্য প্রকৃতি প্রোটিনের মজুদ রেখেছে আমার শরীরে। এই সুস্বাদু প্রোটিনই মশার লক্ষ্য। আমাকে কামড়ানো কিংবা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু বিলানোয় এর সময় কোথায়।
আসলে দৃশ্যমান জগতটি নির্ভর করে কোনো প্রাণীর দেখার ক্ষমতার উপর। মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কাররের পূর্বে অনুজীবদের কোনো ধারণাই ছিলনা মানবজাতির। মানুষ এখন বুঝতে পারে প্রাণীদেহ কোনো একক সত্তা নয়, অসংখ্য কোষের সমষ্টি মাত্র। কোষের জটিল গঠন বৈচিত্র্যও জেনে ফেলেছে। এমনকি জীবনতত্তে¡র সূত্রও তাঁদের হাতের মুঠোয়।
হাজারো আণুবীক্ষণিক জীবের মধ্যে হালের বহুল আলোচিত করোনাভাইরাসও অন্যতম। অণুজীব বিজ্ঞানীরা অবশ্য ভাইরাসকে জীব ও জড় এর কোনটই মানতে নারাজ। ভাইরাসের নিউক্লিয়াস নাই, বিপাক নাই কিন্তু শারীরিক বিভাজন আছে। এগুলো সজীবও নয়, নির্জীবও নয়। পোষক (প্রাণীদেহ) এর কোষে অবস্থান নিয়েই কেবল বিভাজিত হতে পারে।
এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসটি এত দ্রæত গতিতে বিভাজিত হয় যে, এগুলো পোষকের যে টিস্যু/কলায় আশ্রয় পায় সেখানে দ্রæতগতিতে বংশ বিস্তার করে কলোনী গড়ে তোলে। নিজের কোষের অভ্যন্তরে মেহমান (ভাইরাস) এর জন্য জায়গা করে দিতে দিতে পোষক নিজের কোষের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অবশ্য মেহমান আথিতেয়তার তোয়াক্কা না করে নিজেই পোষকের বিভিন্ন আঙ্গে সংসার পেতে বসে। একসময় পোষক হয়ে পড়ে নিজ ভূমে পরবাসী।
এভাবে মেহমানের ভারে আক্রান্ত টিস্যু শরীরের অন্যান্য অঙ্গের সাথে তাল মিলাতে পারেনা। ¯œায়ুতন্ত্রে শুরু হয় সংকট। মস্তিষ্ক পোষকের বিভিন্ন অঙ্গের দূর্ঘটনার খবর সঠিকভাবে পায়না। তাই মস্তিষ্কও কোন জরুরি সিদ্ধান্ত পাঠাতে অপারগ হয়। এই সুযোগে ভাইরাস পোষকের দেহে একধিশ্বর হয়ে সবকিছু দুমড়েমুচড়ে দিয়ে একক রাজত্ব কায়েম করে পোষকের উপর। একসময় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ভাইরাসের কাছে পরাস্ত হয় পোষক (মানুষ)। শেষ পর্যন্ত শক্তিমানকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যায় পোষক। আমরা তখন বলে উঠি আহা ! আহা।
এই ঘটনাগুলো ঘটে সূক্ষ্রভাবে, মানব চক্ষুর অন্তরালে। মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার না হওয়া অবধি এ মৃতে্যুর কোন ব্যাখ্যা ছিলনা। এ অজ্ঞতাকে পূঁজি করে রটানো হতো ‘এটা খোদায়ী গজব’, ‘বিধাতার অভিশাপ’, ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব গজব আর অভিশাপের চিকিৎসা ওঝা-বৈদ্য ছাড়া কি সম্ভব ? ওঝা-বৈদ্যের বীনা চ্যালেঞ্জের ব্যবসা থামায় কোন সে ছাওয়াল !
প্রশ্ন জাগে একটি নিষ্কর্মা ভাইরাস পোষকের কোষে প্রবেশ করার সময় দেহ কি কলা খায় ? দেহের কাজ কি শুধু ‘চেয়ে চেয়ে দেখা’ ? না, মোটেই না। আসলে প্রাণীর দেহ একটি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের মতোই। এতে এন্টিবডি (রোগ প্রতিরোধ শক্তি) থাকে। অপাংক্তেয় কিছুই প্রাণীকোষ সহজে মেনে নেয়না। সর্বশক্তি দিয়ে বহিঃশক্রর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এতে সফলতা আসে বলেই প্রাণীকূলের অস্তিত্ব এখনো বিরাজমান। তবে সবক্ষেত্রে সফল তা-ও বলা যায়না, যেমন- করোনাভাইরাস।
প্ল্যাগ, বসন্ত, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি একসময় মহামারী আকারে আসতো। বহু প্রাণ সংহার করে তবেই ক্ষান্ত হতো। এদের বিস্তার রোখা গেল ভ্যাকসিন, টিকার মাধ্যম। প্রাণীকূল ভরসা পায় বিজ্ঞানীদের উপর।
গজব, অভিশাপতত্তে¡র প্রবক্তারা একসময় মুখ লুকোতে বাধ্য হয়। অনাদিকাল থেকে যারা রোগবালাইকে গজব আর অভিশাপ বলে মুখে ফেলা তোলেছে তারা নিজেরাও এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। অভিশাপতাত্বিকরা নিজেদের যেমন রক্ষা করতে পারেনি, পারেনি এই রোগ প্রতিরোধে কোন ভূমিকাও রাখতে। সর্বক্ষেত্রে ত্রানকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বড় বড় ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে সিনেমা হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মেলা-মজলিশ সব আজ বন্ধ। ধর্মীয় গুরুরা করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার কিছু দোয়া-দরুদ, টিপস্ শিখিয়ে দায় সারছেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের ঘুম হারাম। তারা দিন রাত চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণা। তাদের সাধনা-মানবজাতিকে এই মরণব্যাধি ভাইরাস থেকে কিভাবে মুক্তি দেয়া যায়। আজগবি কথা শোনার সময় কোথায় তাদের।
করোনাকে গজব আর অভিশাপ বলে মুখ নষ্ট করা কেন ? আপনি-আমি যে ধারায় দুনিয়াতে এসেছি করোনাও এর বাইরে নয়। প্রকৃতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমীকরন মেলাতে যে যার অবস্থানে আছে। পার্থক্য একটাই-মস্তিষ্কের উন্নত গঠনের কারণে মনুষ্যজাতি অন্যসব প্রাণীর উপর খবরদারী করে যাচ্ছে। আরো বলছে, ‘দুনিয়ার সব প্রাণীর জন্মই হয়েছে মনুষ্যজাতির আধিপত্য মেনে নিতে’। করোনাও সে যুক্তিতে মনুষ্যজাতির শত্রুর তালিকায় নাম লিখিয়ে পরাজয়ের দিনক্ষণ গুণছে। নতুনভাবে আমরাও করোনার করুণ পরাজয় দেখার অপেক্ষায় আছি। প্রকৃতিতে যোগ্যতমর-ই তো বেঁচে থাকার অধিকার থাকে।
মধ্যরাতে আমার পা থেকে রক্ত খাওয়া দুটি নিরীহ মশাকে মেরে রক্তাক্ত করার কোনো জবাবদিহিই আমাকে করতে হবেনা।
দুনিয়ার প্রচলিত ধারায় এতো জবাবদিহি করলে কি চলে ? আমরাইতো সেরা। বেঁচে থাকার অধিকার তো শুধু আমাদেরই।

লেখক : প্রাবন্ধিক