লোকসভা নির্বাচন : গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এড়িয়ে চলার কৌশল

24

বাহ্যিক চাকচিক্যময় পরিস্থিতি এর আগে কখনোই এতো প্রতারণাপূর্ণ ছিল না। ভারতীয় নির্বাচন নিয়ে উচ্ছ¡সিত সফরকারীদের অনেকেই হয়ত অনুধাবন করতে পারছেন না ভারত গত কয়েক দশকের মধ্যে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।সরকারি পরিসংখ্যানেও পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। গত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। শুধু গত ১২ বছরেই প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ভোগ্যপণ্য উৎপাদন খাতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি আসেনি। শুধু দেশের কিছু অংশে অবকাঠামো ও আবাসন খাতে কিছু ইতিবাচক লক্ষণ বহাল ছিল। কিন্তু প্রাইভেট কার, আধুনিক ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদায় ব্যাপক ধ্বস নেমেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৯ সালে একটি পরিবারের জন্য ভারতে সর্বনিম্ন মাসিক আয় ছিল ১৮ হাজার রুপি। সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে মোট ভারতীয় পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশ মাত্র ১০ হাজার রুপি বা এর চেয়ে কম উপার্জন করছে। এছাড়া, কর্মরত নারীদের মধ্যে ৯২ শতাংশ আয় করছে ১০ হাজার রুপির কম। পুরুষদের অবস্থাও ভালো না। ৮২ শতাংশ আয় করছেন ১০ হাজার রুপি। ১৯৯১ সালের পর থেকে ভারতে সংগঠিত শ্রম ও শ্রমিক শ্রেণিকে মোকাবিলায় মালিকদের ক্ষমতা বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। নিয়োগ ও বরখাস্ত, নিম্ন মজুরি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা নতুন প্রবণতা হিসেবে হাজির হয়েছে।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএনসি) বা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কেউই শ্রমিক শ্রেণির রুটি-রুজির বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা সামনে আনছে না। কংগ্রেস শাসনামলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা শুরু হয়। সংগঠিত শ্রমিক বিক্ষোভ এবং দরিদ্র কৃষক ও অসংগঠিত শ্রমিকদের গণ আন্দোলনে মনমোহন সিংয়ের আচরণের কারণে তার সমালোচকরা তাকে মার্গারেট থ্যাচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ‘বিখ্যাত’ এই অর্থমন্ত্রী যে এখন ক্ষমতায় নেই তাতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। তবু এখনও তিনি ভারতে ও বিদেশে পশ্চিমাপন্থী মিডিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ধনী খনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদের বিষয়ে তার একটি মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি ভূমি থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীদের ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

২০১৪ সালে বিজেপি যখন ক্ষমতায় আসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে নতুন ২০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের শাসনামলে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতিকে গতিশীল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ ছাড়া ২০১৪ সাল থেকে খুব বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নতুন জিএসটি বিধি চালু করার ফলে ৫০ শতাংশ ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এই খাতটিই গত কয়েক বছর ধরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্থিতিশীল ছিল। বছরে ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছিল এই খাতে।
ভারতে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে জাতীয় পর্যায়ে। কয়েম্বাটোর, তামিল নাড়ুর মতো শিল্পোন্নত রাজ্যের সরকারি সূত্র জানিয়েছে, এসব রাজ্যের শিল্প শ্রমিকদের প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ হারিয়েছে। শুধু চাকরি হারানো নয়, যারা কাজে আছেন তারাও এখন আর নিরাপদ নয়। বিজেপির অধীনে ফ্রান্সকে সরিয়ে ভারত বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ার পরও এই অবস্থা বিরাজ করছে। কর্মসংস্থান ছাড়া প্রবৃদ্ধি নতুন রূপ আর সম্পদের কেন্দ্রীভূত হওয়া নতুন প্রবণতায় হাজির হয়েছে। কোটি কোটি ভারতীয় দুর্ভোগ ও অভাব-অনটনের মধ্যে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে করে বিভিন্ন খাতে শিল্পোন্নত ভারতে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটেনি। অথবা মাত্র ১ শতাংশ ধনীর হাতে মোট সম্পদের অর্ধেকের নিয়ন্ত্রণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।