অসামপ্রদায়িক বঙ্গবন্ধু

50

প্রফেসর ড. সেলিনা আখতার

বিশ্বসন্মোহনকারী নেতাদের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার ধারক এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সর্বাগ্রে। তিনি তাঁর অসামান্য নেতৃত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস, দেশপ্রেম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি নতুন মানচিত্র উপহার দিয়েছেন। ১৯৪৭-এ দেশভাগ হয়েছিল ‘দ্বিজাতি তত্ত¡’ এর ভিত্তিতে। এর আগেই সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার সাক্ষী হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ। তরুণ বঙ্গবন্ধু দেখেছেন সেই সা¤প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কীভাবে মানুষকে মানুষের শত্রæ করে তোলে। আর সে কারণেই সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে অসা¤প্রদায়িকতাকেই রাজনীতির মূলমন্ত্র করেছিলেন তিনি। তিনি স্পষ্টই বুঝেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে দুইটি পৃথক ভ‚খÐ ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের একটি দেশে রূপ দেওয়া হলেও সেটি কার্যকর কিছু নয়। পাকিস্তান নামের দেশের পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতাই চ‚ড়ান্ত পরিণতি। সেই ষাটের দশকের গোড়া থেকেই তিনি তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে থাকেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই তার পক্ষে সকল বাঙালিকে এক করা সম্ভব হয়েছিল। ধর্মীয় বিরোধ উপেক্ষা করে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে বাঙালি জয় লাভ করেছে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পা রেখেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন: ‘আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছি, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। দেশে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। দেশের কৃষক, শ্রমিক,হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন যে ধর্মীয় বিরোধের কারণে সামপ্রদায়িকতার উদ্ভব হয়।বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচনা ও গ্রহণ করা হয়, তা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রথম নিরপেক্ষ সংবিধান। বাংলাদেশের এই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আতœনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ তাই ধর্মীয় বিরোধ রোধকল্পে সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে ১২নং অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: ‘ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য ক) সর্বপ্রকার সামপ্রদায়িকতা, খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রথমেই তাঁর একটি উদ্ধৃতি রয়েছে যাতে তিনি তাঁর আত্মপরিচয় দিয়েছেন প্রথমে মানুষ এবং তারপর বাঙালি হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
বাল্যকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন চিন্তা-ভাবনায়, বিশ্বাসে এবং আচার-আচরণে অসাম্প্রদায়িক। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে (পৃ. ২৩) একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি নিচে উদ্ধৃত করা হলো: ‘একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুবভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায়আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম ‘ননী কি হয়েছে ?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরেকাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে, পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।’ বললাম, যাব না, তুই আসিস। ‘এ থেকে বুঝা যায় তিনি আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ব্যাপারে কত উদার ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে হক সাহেব ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবেরগোপালগঞ্জে আগমন উপলক্ষ্যে সংবর্ধনা দিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোককংগ্রেসএর পরামর্শে সহযোগিতা করতে সম্মত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু অবাক হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ১১) : ‘আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমানবলে কোন জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল।একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানÑসবই চলত।’
১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট জিন্নাহ ঘোষিত ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’- কে কেন্দ্র করে কলকাতা ও নোয়াখালী এবং বিহারে প্রাণঘাতী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। হিন্দু মুসলমান একে অন্যের প্রতিপক্ষকে নিরস্ত্র ও অসহায় অবস্থায় হত্যা কান্ড সংঘটিত করত। এই ঘটনায় বঙ্গবন্ধু মর্মাহত হয়ে নিজেকে রিলিফ কাজে নিযুক্ত করেন। যে সব এলাকায় দাঙ্গা সংঘটিত হয়, সে সব এলাকা তিনি সফর করেন। তিনি ওই সব দাঙ্গাপীড়িত এলাকায় ছুটে যান। বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ভারতের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, যিনি ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষকতা করতেন, তিনি তাঁর ‘ষাট দশক’ শিরোনামের বইয়ে দাঙ্গার সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘ইসলামিয়ার ছাত্ররা যে আমাদের জন্য কতটা করতে পারত তার প্রমাণ পেলাম ১৯৪৬এর রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। বালিগঞ্জ থেকে ইসলামিয়া কলেজের রাস্তায় পদে পদে বিপদ। এই রাস্তা আমাদের ছাত্ররা পার করে দিত। ওরা বালিগঞ্জের কাছে অপেক্ষা করত আর সেখান থেকে ওয়েলেসলি স্ট্রিটে কলেজে নিয়ে যেত। আবার সেভাবেই ফিরিয়ে দিয়ে যেত। এখানে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি ইসলামিয়া কলেজের সেইসব মুসলমান ছাত্রদের, যাঁরা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে বিপজ্জনক এলাকাটা পার করে দিতেন। এইসব ছাত্রদের একজনের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান’।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মুসলমানদের উদ্ধারকরতে গিয়ে তিনি অনেক হিন্দুদেরও উদ্ধার করেছেন। তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (পৃ. ৬৬) -তে লিখেছেন: ‘মুসলমানদের উদ্ধার করতে কাজও করতে হচ্ছে। দু’এক জায়গায় উদ্ধারকরতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি।’ বঙ্গবন্ধু সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পর্কে আরও লিখেছেন (‘অসমাপ্তআত্মজীবনী’, পৃ. ৬৭): ‘একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান হিন্দু পাড়াপড়শীকেরক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিমলীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাইকরেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়েযেতে বলেছে,… নতুবা… এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।’ বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী সচেতনা সৃষ্টির জন্য কারাগারেরভিতরেও দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের কোনো দিন দাঙ্গা না করার জন্যউপদেশ দিতেন। এ সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ১৭০): ‘আমরা যখন জেলে তখন এক রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, কলকাতা ওঢাকায়। কলকাতায় নিরপরাধ মুসলমান এবং ঢাকায় ও বরিশালে নিরপরাধহিন্দু মারা গেল। কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিল যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেবকে কলকাতায় হত্যা করেছে। আর যায় কোথায়! মুসলমানরাও ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের অনেক লোককে গ্রেফতার করে আনল ঢাকা জেলে।আমরা যেখানে থাকি সেই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডেই এদের দিনের বেলা রাখত। আমার মনে হয়, সাত-আটশত লোককে গ্রেফতার করেছে। আমি তাদেরসাথে বসে আলাপ করতাম। সকলেই অপরাধী নয়, এর মধ্যে সামান্য কিছু লোকই দোষী। সাধারণত দোষী ব্যক্তিরা গ্রেফতার বেশি হয় না। রাস্তার নিরীহ লোকই বেশি গ্রেফতার হয়। তাদের কাছে বসে বলি, দাঙ্গা করা উচিতনা; যে কোনো দোষ করে না তাকে হত্যা করা পাপ। মুসলমানরা কোনো নিরপরাধীকে অত্যাচার করতে পারে না, আল্লাহ ও রসুল নিষেধ করে দিয়েছেন। হিন্দুদেরও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তারাও মানুষ। হিন্দুস্তানের হিন্দুরা অন্যায় করবে বলে আমরাও অন্যায় করবÑএটা হতে পারে না। ঢাকার অনেক নামকরা গুরু প্রকৃতির লোকেদের সাথে আলাপ হল; তারাঅনেকেই আমাকে কথা দিল, আর কোনোদিন দাঙ্গা করবে না।’ ১৯৫৪ সালের ১৫ মে বঙ্গবন্ধু শেরে বাংলার মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। কিন্তু সেই রাতেই আদমজী জুটমিলে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা বাঁধানো হয়। এটা ছিল যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দেয়ার সুগভীর চক্রান্তের অংশ। সে সময়ের লাটভবনে শপথ গ্রহণ শেষ হতে না হতেই আদমজীতে দাঙ্গার খবর আসে। বঙ্গবন্ধু মুহূর্ত দেরি না করে সেখানে চলে যান। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংঘর্ষের এলাকায় পৌঁছান এবং পরিস্থিতি শান্ত করায় সক্রিয় ভ‚মিকা রাখেন। গভীর রাতে ঢাকায় ফিরে তিনি অবাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা সফর করেন। আদমজীর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকায় যেন সা¤প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন।
১৯৬৪ সালের বাঙালি-বিহারি দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছিলেন। নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ সহিংসতার মধ্যে জনসাধারণ বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তিনি দাঙ্গা-বিরোধী কমিটি থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও’ লিফলেট প্রকাশ করে বিতরণ করেছিলেন। দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির আহবায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ লিফলেট প্রচার করার দায়ে তাঁকে পাকিস্তান প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিনেন্স এবং পাকিস্তান দন্ডবিধি প্রয়োগ করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে মুক্তিলাভ করেন।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধকালীন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে জনগণকে সাম্প্রদায়িক বিরোধ সম্বন্ধে হুঁশিয়ার করে দিতে এতটুকু ভোলেননি। তিনি বলেন, ‘শুনুন, মনে রাখবেন, শত্রæবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দাযিত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক চেতনার বরপুত্র। তাইতো ১৯৭৩ সালে ফেব্রয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শাসনতন্ত্রে লিখে দিয়েছি যে, কোনোদিন আর শোষকরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। আমি বাঙালি। বাঙালি জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই সম্মানের সঙ্গে। আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, বুদ্ধিষ্ট তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাঁধা দিতে পারবে না। তবে একটা কথা হল, ধর্মের নামে আর ব্যবসা করা যাবে না।’
১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিলেন আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে। এ সম্মেলনে বৈঠক হয় লিবিয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে। গাদ্দাফি বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান, বাংলাদেশ তাঁদের কাছে কী চায়?বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা চাই লিবিয়ার স্বীকৃতি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি লিবিয়ার স্বীকৃতি।’ গাদ্দাফি জানান, এর জন্য বাংলাদেশের নাম বদলে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ ঘোষণা করলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিসহ সবধরনের সহযোগিতা দিবেন। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সাথে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘এটি সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশ সবার দেশ। মুসলমানÑঅমুসলমান সবার দেশ।’ বাদশাহ ফয়সালকে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের দেশটার নামও তো ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদি এরাবিয়া’ নয়। কই আমরা কেউই তো এ নামে আপত্তি করিনি।’ বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি এর সঙ্গে কখনো আপস করেননি।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনদিন সামপ্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামিন। রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তাঁর কাছে সমান। সেই জন্যই এক মুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আরেকমুখে সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চরতে পারে না। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যাও। আওয়ামীলীগের কর্মীরা তোমরা কোনদিন সামপ্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন না করতে পারে।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তিনি সারা জীবন ধর্মের অপব্যাখ্যা, ধর্মের নামে সহিংসতা, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। অসাম্প্রপ্রদায়িকতা বলতে যে তিনি সব স¤প্রদায়ের সহ-অবস্থানের কথা বলেছেন শুধু তা-ই নয়, সংখ্যাগুরু স¤প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার যে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে, সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন এবং সে উদ্দেশ্যে তিনি সারা জীবন কাজ করেন। পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িকতা এখন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একত্রে বসবাস করতে গেলে সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতির বিকল্প নাই। তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ ধারণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর যেমন মৃত্যু নেই ঠিক তেমনি তাঁর আদর্শেরও মৃত্যু হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হতে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত রেখে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলব এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : উপাচার্য- রাঙ্গামাটি বিঞ্জান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়