50

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা ও মে দিবস
কাজী সামশুর রহমান

‘শ্রম’ উৎপাদনের অন্যতম এক উপাদান। আধুনিক অর্থনীতিতে উৎপাদনের ৪টি উপাদান যথা: ভূমি, শ্রম, মূলধন ও উদ্যোক্তা। ভূমির মূলধন বিদ্যমান থাকলেও শ্রমের অভাবে উৎপাদন সম্পন্ন করা অসম্ভব। সৃষ্টির আদি হতেই এর (শ্রম) অপরিসীম প্রভাব ও গুরুত্ব বিবেচিত হয়ে আসছে। ইউরোপ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে শত শত বছর ধরে, শ্রমিকদের দাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল ঊনবিংশ শতাব্দির শেষার্ধ পর্যন্ত। এরই ধারাবাহিকতা মধ্যপ্রাচ্যেও পরিলক্ষিত হয়। দাসপ্রথা উচ্ছেদের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু মনীষী কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন সময়ে সময়ে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রমের ন্যায্য মজুরী ও দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জার্মানিতে গঠিত হয় সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় গঠিত হয় সোশ্যালিষ্ট লেবার পার্টি, ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে গঠিত হয় ওয়ার্কাস পার্টি, পূর্বে বান্টিমোরে ৬০টি শ্রমিক সংগঠন প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার লেবার ফেডারেশন এ দাবিকে আরো জোরদারকরে তোলে এবং মালিক শ্রেণি যদি দাবি মেনে না নেয় তাহলে অনির্দিষ্ট ধর্মঘট পালন করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে। এ ধর্মঘট শুরুর তারিখ নির্ধারিত হয় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ মে। সকল শ্রমিক সংঘটন এ দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেটে’ জুতো কারখানার শ্রমিকগণ অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেন। মালিকদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। ৬জন শ্রমিক নেতাকে হত্যা করা হয়। শত শত শ্রমিককে অমানুষিক নির্যাতন করে গ্রেফতার করা হয়। সে সময়কার প্রত্রিকাওয়ালারা শ্রমিকদের উপর কুকুর লেলিয়ে দাও, গুলি করে মেরে ফেল, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও এভাবে নিউজ করে। ৪জন শ্রমিক নেতাকে প্রহসনের প্রচারে ফাঁসি দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত কাজের সময় দৈনিক ৮ ঘণ্টা স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মহাদেশে পরবর্তীতে বিশ্বের সকল দেশেই ১ মে স্মরণে শ্রমিকদের বিজয় দিবস হিসেবে ‘মে ডে’ ‘মে দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। ইউরোপ আমেরিকায় শ্রমিকদের দাবি দাওয়াসহ শ্রমের স্বীকৃতি পেলেও এশিয়া আফ্রিকার প্রায় সব দেশেই আংশিক দাবি দাওয়া মেনে নেয়া হয়। শ্রমিক নির্যাতন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যবাপার এ সব দেশে। শ্রমিক নেতাদের ফাঁসির দন্ড মওকুফ করর জন্য যে সব মনীষী সোচ্চার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যত হল খ্যাতনামা দার্শনিক জজ বার্নাডশ। ঝড়ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর অবস্থা প্রত্যক্ষ করে সুখ-শান্তির আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন পবিত্র ইসলাম। তিনি বলেছিলন- ‘‘If all the world was united under one then Mohammad (S.M) would have been the best fitted to lead the peoples of various creeds,dogmas and ideas to peace and happiness.’’ ‘‘সমগ্র পৃথিবীটাকে একজন নেতার অধীনে একত্র করা হতো, তাহলে সর্বোত্তম ও যোগ্যতম ব্যক্তি হতেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যাঁর পক্ষেই সম্ভব নানা ধর্মমত, ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তাধারার মানুষকে শান্তি ও সুখের পথে পরিচালিত করা।’’
পবিত্র ইসলাম ধর্মে শ্রমের ও শ্রমিকের মর্যাদা কতটুকু নিশ্চিত করেছে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়: আমাদের প্রিয়নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্র গযব যাদের উপর পতিত হবে তাদের মধ্যে রয়েছে যারা শ্রমিকদের দ্বারা পুরোপুরি কাজ করায় অথচ ন্যায্য মজুরি প্রদান করে না। [সহীহ বুখারী শরীফ]
হুযূর আরো বলেছেন, ‘তোমরা যাকে চাকর বলো আসলে সে তোমার ভাই। আল্লাহ্ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমার অধীনস্থ ভাইকে তুমি যা খাবে তাকে সেটাই খেতে দেবে, তুমি যা পরিধান করবে তাকে সেটাই পরতে দেবে এবং তার উপর এমন কোন কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ো না যা তার পক্ষে করা অসম্ভব হয়। [সহীহ বুখারী শরীফ]
এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায়- ‘‘মালিকের অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান যেমনটা হবে, তেমনটাই শ্রমিকেরও নিশ্চিত করতে হবে।’’ প্রিয়নবী যথাসময়ে ন্যায্য মজুরি দেবার তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাবার পূর্বেই তার ন্যায্য মজুরি দিয়ে দেবে।’ [ইবনে মাজা শরীফ]
হাদীসে কুদসীতে আছে যে, আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আমি (আল্লাহ্) যে তিন ধরনের লোকের বিপক্ষে তারা হচ্ছে- আমার (আল্লাহ্) নামের ওয়াদা করার পর যে লোক তা ভঙ্গ করে এবং যে লোক শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে তার মূল্য ভক্ষণ করে এবং যে লোক শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে তার দ্বারা নিজের কাজ আদায় করে নিয়ে তার পারিশ্রমিক দেয় না। [বুখারী শরীফ]
আল্লাহ্ জাল্লাশানুহু সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছেন। কেউ খাবে, কেউ খাবে না, এ অসম নীতির বিরুদ্ধে ইসলাম সব সময় সোচ্চার হয়েছে এবং এমন এক সুষম ব্যবস্থা সুসংহত করেছে যার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি বিকশিত হয়েছে। এ শ্রমনীতিতে মালিক শ্রমিকের ব্যবধান দূর করা হয়েছে এবং ইনসাফ ও আদল নিশ্চিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন সংস্থা প্রণীত শ্রম আইন আমাদের দেশে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে শ্রম অসন্তোষ অনেকটাই হ্রাস পাবে সত্য, তবে ইসলাম প্রবর্তিত শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা গেলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বিশ্ববাসী।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাবেক শ্রমিক নেতা