হুজুগের সুযোগে গুজবের গজবে

27

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

হুজুগে বাঙালি, গুজবে বাঙালিÑকথা দুটি সমার্থক।‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।’ শামসুর রহমানের কবিতাটি আমাদের চরিত্রের সাথে বরাবর যায়।চিল কান নিয়েছে বলাতে আমরা চিলের পিছে ছুটি, কিন্তু কানে হাত দিয়ে দেখিনা কথাটি সত্য কি-না। সেই সুযোগে বুদ্ধিমানরা গুজব রটিয়ে আমাদের খালিকরে দেয়, আর আমরা খালি হওয়ার পর ভাবি কেন আগে সতর্ক হলাম না? বছর সাতেক আগে ২০১৬ সালে ডেসটিনি গ্রæপ নামে এক এমএলএম কোম্পানির বিরাট প্রতারণা ধরাপড়ে। হাটহাজারী, বান্দরবনের দুর্গম পাহাড়ে নাকি গাছ লাগিয়েছে, কিছু টাকা দিয়ে সে গাছ কিনে নিলে কয়েক বছর পর লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হওয়া যাবে। তারপর জানা গেল, সব মিথ্যেকথা তাদের কোন গাছের বাগান নাই। কেউ কেউ বলছেন, গাছগুলা সব ছাগলে খেয়েছে। কথা হচ্ছে যারা এই ফাঁদে পড়েছে তাদের মাথায় কি এই বুদ্ধিটাও এলো না যে, সেই টাকা দিয়ে নিজেরা কোন স্থানে গাছ লাগিয়ে পরিচর্যা করলে অনেক বেশী ফায়দা পাওয়া যেত?
আসলে কথায় আছে নাÑপরের বউ সুন্দর বেশী, দুষ্টুর কথা মিষ্টি বেশী। কিন্তু সেই কথাতে বার্তা কিছু আছে কিনা দেখি না। মাশাল্লাহ্ শেয়ার বাজার একটা খেল দেখাল। দশ টাকার শেয়ারের দাম হয়ে গেল হাজারটাকা! ফলে আমরা হুজুগে বাঙালি আর দেরী করলাম না, যেখানে যা আছে সব বিক্রি করে ঢুকিয়ে দিলাম শেয়ারের ভেতর। বিদেশ ফেরত বাঙ্গালী আর বিদেশ গেল না, সারা জীবনের কামাই সব ঢেলে দিল শেয়ার বাজারে। কদিন যেতেই যা হবার তা হলোÑসকাল বেলায় আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যা বেলা। কতজন যে তারপর গলায় দড়ি দিয়ে, ছাদ হতে লাফদিয়ে আর মুখে বিষ ঢেলে যে আত্মহত্যা করল তার ইয়ত্তা নেই। একসময় সত্তরের দশকের শেষভাগ হতে গোটা আশির দশক দুবাই যাওয়ার হিড়িক। সবার মুখে খালি টাকা দাও দুবাই যামু, দুবাই যামু টাকা দাও। বাপ-দাদার জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর বিক্রি করে গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। তারপর ধরা খেয়ে জেল খেটেছে, কিংবা সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। বাড়িতেও কি করে ফিরবে? বাড়ি-ঘর তো আগেই বিক্রি করে ফেলেছে। আবার দেখলাম ইউরোপ যাবার হিড়িক, ইটালি ঢুকার জন্য লিবিয়া-সুদানের মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরে। কেউ কেউ আবার দিক হারিয়ে মরুভূমিতেও শুকিয়ে মরে। আরো দেখি যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকার জন্য মেক্সিকো সীমান্তে সাপের কামড় খেয়ে মরে। এই কাফেলাগুলোতে দেখা যায় প্রচুর বাঙালি ছেলেমেয়ে থাকে।
বছর দুই আগে মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে একটি ট্রাক উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেই ট্রাকভর্তি ছিল মানব সন্তান, তার মধ্যে পঞ্চাশ জন ছিল কেবল বাঙলাদেশী। ট্রাকের একজন প্রাণীও বেঁচে ফিরতে পারে নি। এভাবে প্রতিবছর লাখ লাখ যুবক-যুবতী জীবিকার সন্ধানে জীবন বিসর্জন করে যাচ্ছে অকাতরে। আসলে জীবিকা একটি বড় বিষয়। এই জীবিকার জন্য মানুষ জীবনকে বাজি রাখতে কুণ্ঠিত হয়না। ফলে জীবিকার জন্য মানুষ যা দরকার তা করতে পারে। চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, অপকৌশল, বাটপারি, চুরিচামারি, ধোঁকাবাজি, খুন-খারাবি, রাহাজানি, ইত্যাদি হেন কর্ম নাই, যা মানুষ করতে পারে না। এমনকি জীবিকার জন্য মানুষ জীবনও দিয়ে দিতে পারে।ফলে মানুষের এই মহাদুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও হীনপ্রবৃত্তির সুযোগ নিয়েই কিছু ধান্ধাবাজ, প্রতারক, বাটপার তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে নেমে পড়ে। সেই সকল ধান্ধাবাজদের মধ্যে ডেসটিনি টু থাউজেন্ড যেমন রয়েছে, তেমন ছিল ইউনিপে টু ইউ সহ বিভিন্ন হায়হায় কোম্পানি। আরো আছে শেয়ার বাজার, আদম ব্যাপারী, মানিলন্ডারি, চোরাকারবারি, মাদক পাচারকারী ও নারী কেলেঙ্কারী। এই যে এত সকল প্রতারণাÑ এইগুলি হচ্ছে ফিজিক্যাল বাটপারি, কিন্তু এখন শুরু হয়েছে ডিজিটাল বাটপারি, হিহিহি।
মোবাইলে ম্যাসেজ আসে, অভিনন্দন আপনি লটারিতে পঞ্চশ লক্ষ টাকা জিতেছেন। জলদি ফি বাবদ বিশ হাজার টাকা এ নম্বরে জমা করুন তাহলে আপনি টাকাটা পেয়ে যাবেন। এটি দেখে আমরা আর যাচাই করিনা, টাকা জমা করে দেই এবং তারপর কপালে হাত মারতে থাকি। অনেক সময় দেখা যায় মোবাইলে ফোন আসে। রিসিভ করলে অপর প্রান্ত থেকে এমন গুছিয়ে কথা বলে, তাদের কথার ফাঁদে পড়ে অনেক দুর্বল চিত্তের মানুষ নিজের পিন নম্বরটাই বলে দেয়। বিবিধ ধান্ধাবাজ বিবিধ কারসাজিতে থাকে। সম্প্রতি দেখলাম ডিজিটাল কারচুপির আরেক নতুন রূপ ‘ই মুভি প্ল্যান’। এইটি নাকি একটি অ্যাপ। চাইনিজরা এই অ্যাপটি বানিয়েছে, এটি দিয়ে সিনেমার টিকিট বেচাকেনা করা হয় এবং রাতারাতি এর মাধ্যমে কোটিপতি বনে যাওয়া যায়। পেপার পড়ে যা বুঝলাম, এটিও একটি এমএলএম ব্যবসা। এই অ্যাপের মাধ্যমে দেশীবিদেশী সব বøকবাস্টার মুভির টিকিট কিনে রাখা হয়, এবং পরে বিক্রি করা হয়। বুঝে গেলাম সিনেমার টিকেট বø্যাকার কালোবাজারি, চলছে নানান বাটপারি। মনে পড়ে গেল সেই ঐতিহাসিক দৃশ্যÑআলমাস, জলসা, গুলজার সিনেমা হল সমূহ এবং তাদের আঙ্গিনা। এই রিয়েলস্টল, রিয়েলস্টলÑডিসি, ডিসি, হিহিহিহি।
আহা লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের বাল্যকালের এই আরেক সমৃদ্ধ মধুর স্মৃতি। রাজ্জাক-শাবানা, ওয়াসিম-অলিভিয়ার মুভি যখন চলত, সিনেমা হলগুলোতে থাকত উপচে পড়া ভিড়। টিকিট পাওয়া যেত না, টিকিট কাউন্টারে চলত মানুষের বলি খেলার মহড়া। টিকিট শেষ, বুকিং বন্ধ, হতোদ্যমে হতাশায় নিমজ্জমান যখন মোরা, ঠিক তখনই নিরাশায় শান্তির বাণীর মত ভিড়ের মধ্যহতে ভেসে আসত, ডিসি-স্টল শব্দগুলি। আশায় বুক বেঁধে ছুটে যেতাম শব্দের উৎসের দিকে। দ্বিগুণ, তিনগুণ মূল্য দিয়ে গাল বেঁকা, চোখ ঢুকা, লিকলিকে পাতলা মানুষগুলোর কাছ থেকে টিকিট কিনে নিতাম।
দৃঢ় সংকল্প, দুনিয়া উল্টে যেতে পারে, সিনেমা না দেখে ঘরে ফিরব না, হাহাহাহা। লিকলিকে সেই মানুষগুলি ছিল সিনেমার টিকিট বø্যাকার-কালোবাজারি, ডাক ছাড়ত রকমারি। দিনরাত হলগুলোর বারান্দায় পড়ে থাকত, আগে থেকে বিভিন্ন শো’র টিকিট কিনে রাখত এবং শো শুরুর পূর্বে বেশিদামে বিক্রি করত আর এতে তাদের ভালো একটি আয় হতো। মনে হয় সেই লাভের অংক দিয়ে খালি পান খেত আর গাঁজা টানত। কারণ ঠোঁট দুটি লাল, মুখের ভেতরটা থাকত কালো, চোখ থাকত ঢলঢল। পানের কারণে গালের এক পাশটা সুপারি গোটার মতো হয়ে থাকত। আত্মস্বত্ব তেমন করতে পারত না, ফলে যেই নালে আশ সেই নালে নাশ।
ভাবছি আমাদের মত ভোঁদাই কি এখনো আছে, যারা দু-চারগুণ বেশিদাম দিয়ে টিকিট কিনে সিনেমা দেখে? না, মানে পেপারে পড়লাম যারা ই-মুভি প্ল্যানে বিনিয়োগ করেছে তাদের মাসে দ্বিগুণ থেকে ৩৬০ গুণ পর্যন্ত নাকি লাভ হচ্ছিল মাশাল্লাহ্, হাহাহাহা! সুতরাং আমাদের মতো ভোঁদাইরা যদি না থাকে তবে কোন পাগলে এত বেশিমূল্য দিয়ে টিকিট কিনে ‘ই-মুভি প্ল্যান’ অ্যাপ গ্রাহকদের রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দেবে? আমরা যখন ভোঁদাই ছিলাম তখন ঐ সব উষ্কখুষ্ক চুলের গালভাঙ্গা, কুঠুরি চোখের মাদকসেবী বø্যাকারদের ছিল পোয়াবারো। ঘর হতে টাকা চুরি করে আমরা পাঁচ টাকার টিকিট বিশটাকা দিয়ে কিনে সিনেমা দেখতাম। তবে কথা হলো আমাদের সেই সখ আশিতেই বাসি হয়ে গিয়েছিল। তারপর খালি আমরা না, কেউই সিনেমা তেমন দেখতনা। ভি সি আর এসে আশির দশকে সিনেমাকে একদম বসিয়ে দিয়েছিল। নব্বই’র দশকে তো সিনেমা হল সুদ্ধ উঠে যেতে লাগল। ফলে হল মালিকদের চলা মুস্কিল হয়ে দাঁড়াল, সে জায়গায় বø্যাকাররা টিকবে কোত্থেকে? অতএব যার মতো সে সরেগিয়ে হয়ত ভিন্ন কোন লাইন ধরেছে, কাউকে কখনো আজকাল রাস্তাঘাটে পর্যন্ত দেখি না। আমি টিকিট বø্যাকারদের কথা বলছি। দুইহাজারের পর ফেসবুক, ইউটিউব এসে তো বিনোদনের সকল মাধ্যমেরই বারটা বাজিয়ে দিয়েছে, সেখানে সিনেমা আর কোন সার।
এতদিন পর এসে আজ যখন পেপারে দেখলাম, ‘অ্যাপে গ্রাহক হয়ে বিদেশি সিনেমারটিকিট কিনে রাখলেই লভ্যাংশ। যত টিকিট তত লাভ। টাকায় নয়, বিনিয়োগ-লাভের সব হিসাব মার্কিন ডলারে। অ্যাপে জমা রাখা ডলার লাভে-মূলে এক মাসেই বেড়ে দ্বিগুণ থেকে ৩৬০ গুণ পর্যন্ত হচ্ছিল।’তখন মাথা কার ঠিক থাকে বলুন?বিবেচনাবোধ কি তখন আর বাকি থাকে? বিনা কষ্টে এতো লাভ, ঘরে বসে কোটিপতি, বাড়িগাড়ি রাতারাতি। এমন অবস্থায় কে বসে আমার মত চিন্তা করবে সিনেমার আশি আর নব্বই দশকের কথা? নগদ নারায়ণ, যা পাই তা লাভ। আশি-নব্বইর কথা ভাববার সময় এখন কি আছে? মনে পড়ে গেল ইউনি পে টু’র কথা। ওরে বাবা, ওআর নিজাম রোডের একটি বাসার দোতলা থেকে নিচ পর্যন্ত ভীষণ ভিড়! লোকে লোকারণ্য, সবাই খালি হিসাব খুলায় ব্যস্ত। টাকা দিচ্ছে কোন ডকুমেন্ট নাই, কিন্তু তারজন্য কারো কোন আপত্তিও নাই। মা-গো কি অন্ধ বিশ্বাস! কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বিফল মনোরথে ফিরে এলাম প্রশ্নের কোন জবাব না পেয়ে। আমার আবার একটি বাজে অভ্যাস আছে। সবকিছুতে খালি প্রশ্ন করি, ফলে কেউ দাম দেয় না। কাজেই সুয়োগ খালি হাত ছাড়া হয়ে যায়। কারণ কিছুই সহজে বিশ্বাস করি না, আর কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। তবে সেবার বিশ্বাস না করে বড়ো বাঁচা বেঁচেছি। কারণ সপ্তাহ না যেতেই খবর পেলাম ‘ইউনি পে টু’ ফুটে গেছে। অনুরূপ দেখলাম ই-মুভি প্ল্যানও পথে বসেছে। রাতে যারা ছিল কোটিপতি, দিনে হয়ে গেল খয়রাতি, হিহিহি।
আচ্ছা ই-মুভি প্ল্যানে বিনিয়োগ করার কোন যৌক্তিকতা আছে? সেটি একটি চাইনিজ অ্যাপ, চীন থেকে নিয়ন্ত্রিত। তাদের সাথে এই বিষয়ে আমাদের কোন বাইন্ডিংসও নাই। তাহলে কোন ভরসায় হাজার মাইল দূরহতে একটি হায়হায় অ্যাপে আমাদের হুজুগেরা গুজবে কান দিয়ে টাকাগুলা ভরে দিল? এত মানুষ অ্যাপের গ্রাহক হল, কেউ একবার ভেবে দেখল না, সিনেমার টিকিট বেচে কি সেরূপ আয় হয়? এখন কি সিনেমার সেই পাগল আছে, না সেই চাহিদা আছে যে, আমাদের মত তিন-চারগুণ বেশি দাম দিয়ে সিনেমা দেখবে? সেই রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই, তারোপর হায়হায় কোম্পানিগুলোর প্রতারণা। ব্যাংক, বীমা, শেয়ার বাজার খালি করে দেয়ার পরও জনতা তাদের বিশ্বাস করে ফের ই-মুভিতে টাকা খাটায়! একেই বলে বারবার লাথি মারে তবু না ছাড়ি তারে হেহেহেহে।
লেখক : কলামিস্ট