হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র আহ্বান ও হজ

135

 

হজপবিত্র এক ইবাদত। ইসলামের পাঁচ রুকনের একটি। যাদের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ আছে তাদের উপর হজফরজ। আভিধানিক অর্থে কোন মহৎ কাজের ইচ্ছা বা সংকল্প করাকে হজবলে।
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কিছু নিয়মনীতির মাধ্যমে বাইতুল্লাহ শরীফ ও কয়েক স্থানের নির্ধারিত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে যে ইবাদত আদায় করা হয় তাকে হজবলা হয়।
হজকোন নতুন ইবাদত নয়, মানুষ প্রাচীনকাল হতে খানায়ে কাবার জিয়ারত ও হজকরে আসছে। মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশে হযরত জিব্রাইল (আ.) শেখানো পদ্ধতিতে হযরত আদম (আ.) খানায়ে কাবার তাওয়াফ ও জিয়ারত করেন। সে সময় হতে এ ঘরে তাওয়াফ ও জিয়ারত চালু রয়েছে। হযরত নুহ (আ.)’র মহাপ্লাবনের সময় এ ঘর মাটিতে চাপা পড়ে যায়। এরপর হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে এ মর্যাদা ঘরের পুনঃ নির্মাণের নির্দেশ দেন। আবার এঘরকে কেন্দ্র করে হজসম্পাদন হতে থাকে।
আল্লাহর ফেরেস্তারা এঘর প্রথম নির্মাণ করেন। এরপর হযরত আদম (আ.), অতঃপর হযরত ইব্রাহিম (আ.) নির্মাণ করেন। এই কাবা গৃহই দুনিয়ার প্রথম ইবাদতের ঘর পবিত্র কোরআনে তার উল্লেখ আছে।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘মানব সম্প্রদায়ের জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর নির্মিত হয় তা বক্কা (মক্কা), এ ঘর বরকতময় এবং মহাবিশ্বের জন্য দিশারী (৩ঃ৯৬)
হয়রত আদম (আ.) জান্নাত হতে দুনিয়াতে আগমনের পর তিনি মহান আল্লাহ পাকের দরবারে ইবাদতের জন্য একটি ঘর নির্মাণের প্রার্থনা জানালে আল্লাহ তাঁকে কাবাঘর নির্মাণের হুকুম প্রদান করেন। হযরত জিব্রাইল (আ.)’র দেখানো স্থান ও নকশা অনুযায়ী তিনি এঘর নির্মাণ করেছিলেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) খানায়ে কারা পুনঃনির্মাণের পর হযরত জিব্রাইল (আ.) এ ঘরের তাওয়াফ ও হজকরার কথা বলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ঈসমাইল (আ.) উভয়ই হজসম্পাদন করেন। এরপর মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত হুকুম দিলেন, হে ইব্রাহীম! তুমি বিশ্ববাসীর নিকট হজের ঘোষণা প্রদান কর। তিনি বলেন, হে মহান রাব্বুল আলামীন আমি কি ভাবে সমগ্র বিশ্বে হজের ঘোষণার আওয়াজ পৌঁছিয়ে দিব? মহান আল্লাহ পাক বললেন, তুমি ঘোষণা দাও মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। হযরত অইব্রাহিম (আ.) একটি উচুঁ স্থানে দাঁড়ালেন, তখন মহান আল্লাহ পাক তাঁর কাছে দৃশ্যমান করলেন। তিনি চারদিকে ফিরে ঘোষণা করলেন, ‘হে মানবমন্ডলী ! আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ শরীফেরে হজকরা তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নির্দেশে সাড়া দাও।
হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র এই আহŸান বিশ্বব্যাপী পৌঁছে গেল, যেসব মানুষের তকদিরে হজকরার কথা লিখা আছে তারা আধ্যাত্মিক ভাবে উচ্চস্বরে ‘লাব্বায়িকা’ ধ্বনি উচ্চারণ করে তাঁর আহŸানের জবাব দিলেন। যারা এ আহŸানের একবার জবাব দিয়েছে তারা একবার হজসম্পাদনের পেয়েছে বা পাবে আর যারা একাধিক বার জবাব প্রদান করেছেন তারা একাধিক হজসম্পাদনের সুযোগ পেয়েছে বা পাবে।
হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র পর যত নবী রাসুল দুনিয়াতে শুভ আগমন হয়েছে তাঁরা সবায় হজসম্পাদন করেছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, মানুষের মধ্যে যার যেখানে যাওয়ার সামর্থ রয়েছে তাদের আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ ঘরের হজকরা কর্তব্য। (৩;৯৭)।
মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজজত পবিত্র কোরআনে আরো ঘোষণা করেছেন এবং মানুষের নিকট হজের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার নিকট আসবে পায়ে হেঁটে এবং বিভিন্ন ক্ষীণকায় উষ্ট্র সমুহের পিঠে, আসবে দূর দূরান্ত হতে। (২২ ঃ ২৭) বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত আছে, মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তরের উপর। (১) আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসুল একথার সাক্ষ্য দেয়া। (২) নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। (৩) যাকাত আদায় করা। (৪) রমজানের রোজা রাখা। (বোখারী শরীফ)
অধিকাংশ মুজতাহিদদের মতে নবম হিজরীতে হজফরজ হয়। নবম হিজরীতেই হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে আমিরুল হজকরে মহানবী হযরত মাহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাতে পাঠান। তাঁর সাথে বহু সাহাবী হজসম্পাদন করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবীজীর নির্দেশক্রমে পবিত্র মক্কা নগরীতে ঘোষণা করেন, আগামী বছর কোন মোশরিক হজপালন করতে পারবে না এবং উলঙ্গ অবস্থায় কোন ব্যক্তি কাবা ঘরের জিয়ারত করতে পারবে না। এরপর দশম হিজরীতে আল্লাহ রাসুল (দ.)’র নেতৃত্বে লক্ষাধিক মুসলমান নিয়ে পবিত্র হজসম্পাদন করা হয়। এটি ছিল প্রিয় নবী হযরত মাহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের একমাত্র হজ্ব। এই হজের মাধ্যমে হজের ব্যাপক সংস্কার হয়। হজআবার হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র সময়কালের মত শিরক ও বিদ্আত মুক্ত হয়ে তাওহিদের প্রতীকে পরিণত হয়। হজের আহকাম সমূহ মুসলমানগণকে আখিরাতের কথা স্মরণ করে দেয়। মানুষ যখন হজের উদ্দেশ্যে আত্মীয় স্বজন, পরিবার, প্রতিবেশি সবাইকে ছেড়ে যখন হজে যান তখন পরকালের সফরের কথা মতে করিয়ে দেয়। ইহরামের দুই টুকরো সাদা কাপড় মৃত্যুর পর কাফনের কাপড়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ এই তালবিয়া পাঠ কিয়ামতের দিন আল্লাহর আহ্বানের সাড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। খানায়ে কাবার চারদিক তাওয়াফ আরশে আজিমের চতুর্দিক প্রদক্ষিণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সাফা ও মারওয়া সারী হাশরের ময়দানে এদিক ওদিক ছুটাছুটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আরফাতের ময়দানে অবস্থান হাশরের ময়দানে অবস্থানে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সূর্যের প্রচন্ড গরমে হাশরে ময়দানে অবস্থান করতে হবে। হাশরের বিচার আরাফাতের ময়দানে হবে, এমন মত পাওয়া যায়। হজের প্রতিটি আমল দ্বারা আখিরাতের চিত্র হাজীদের সামনে ভেসে উঠে।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক