সেলাই দিদিমণি

61

 

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার আইরকান্দি গ্রাম।সুজলা,সুফলা শস্য শ্যামলা নিভৃত একটি গ্রাম। সে গ্রামে উমেশ চন্দ্রের বড়িটি ছিল দেখার মতো। টরকীচর ঘেঁসে ঐ বড়িটিতে বহুদিন ধরে বসবাস করে আসছেন তিনি। ছোটখাটো ব্যবসা করে পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে বেশ ভালই কাটছিলো তার সংসার। চার মেয়ে এবং এক ছেলের মধ্যে বিভা রানী ছিল সবার বড়। কিশোরীকাল উত্তীর্ণ শ্যামলবর্ণের এ মেয়েটিকে দেখলে কেন জানি মায়া ধরে যেত । শ্যামলবর্ণের ঐ মেয়েটি মানে বিভা রানী ছিল ঐ বাড়ির প্রাণ। টরকী হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন বিভারানী। ঐ উমেশ চন্দ্রের বাড়ির সবাই এমন কি স্কুলের হেড মাস্টার মশাই ও বিভাকে ভীষণ ভালবাসতো। উমেশ চন্দ্রের সাথে দেখা হলেই বলতো -বুঝলে উমেশ, তোমার মেয়ে অনেক মেধাবী। লেখা পড়ার যা ধার-মেয়েটাকে ঠিকঠাক মতো যত্ন নাও। দেখবে ও একদিন অনেক বড় হবে। উমেশ হেড মাস্টারের মুখে মেয়ের প্রশংসা শুনে একদম লাল হয়ে যেতেন আর দুহাত জোড় করে বলতেন-‘তাই যেন হয় মাস্টার মশাই,তাই যেন হয়’।

১৯৭১ সালের জ্যৈষ্ঠের কোন এক দিন। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে চারিদিকে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।চারিদিকে পাকিস্তানি আর্মি বাহিনী বড় বড় হিন্দু বাড়ি গুলোতে আগুন দিচ্ছে। টরকী বন্দর দখল করে নিয়েছে তারা। উমেশ চন্দ্রের বাড়ির সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে গেছে। বাড়ির অন্য সবাই উমেশকে তার যৌবতী কন্যা বিভা রানীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে বললেন। উমেশ চন্দ্র ছোট ছোট পাঁচ ছেলে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। উমেশ বাড়ির সবাইকে নিয়ে তার নিকট আত্মীয় বিরেন্দ্র মজুমদারের বাড়ি কালকিনির রমজানপুরের উদ্দেশ্যে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।বিভা রানী তার সমবয়সী কয়েকজন হঠাৎ পথ ভুলে দলছাড়া হয়ে গেলেন। বিরেন্দ্র মজুমদারের বাড়ির খুব কাছাকাছি আলবদর রাজাকার আইয়ুব আলী বেপারী তার দলবল নিয়ে আগে থেকে ওঁত পেতে ছিলেন। বিভা রানী নিজেকে এই সব হায়েনার হাত থেকে বাঁচাতে দৌড়ে গিয়ে আখ ক্ষেতে লুকালেন। হায়েনাদের যেমন তাদের শিকার খুঁজে পেলে চোখ গুলো চক চক করে উঠে ঠিক তেমনি রাজাকার আইয়ুব আলী বেপারী সুন্দরী যৌবনা বিভা রানীকে দেখে কুকুরের মতো লালা ঝরাতে লাগলো। আখ ক্ষেতের মাঝ খানে গিয়ে বিভার শরীরকে খোবলে খোবলে খেলো আলবদর,রাজাকার হিংগ্র নরপিশাচ আইয়ুব আলি বেপারী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা।কালের সাক্ষী সে আখ ক্ষেত এখন আর নেই, কিন্তু কালের সাক্ষী সেদিনের গুমট মন খারাপের আকাশটা আজো ঠাই দাড়িয়ে আছে। সে এক দুর্বিষহ আঁধার ঘনিয়ে এলো।চলতে লাগলো বিভা সহ অন্য মেয়ে গুলোর উপর অমানবিক পাশবিক নির্যাতন।বিভার কুমারীত্ব হারাবার রক্তাক্ত আর্তনাদ সে দিন মিলিয়ে গেল আইয়ুব গংদের ক্ষিপ্ত নখের আঁচড়ে।
পরদিন খুব সকালে সেই আখ ক্ষেতের পাশে অনেক টা অবচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা বিভাকে খুঁজে নিয়ে উমেশ চন্দ্র বাড়িতে নিয়ে গেলো।বাড়িতে সব ঘরবাড়ি পুড়ে ছারখার।পাক আর্মিদের নির্দেশে দেশিয় রাজাকারেরা গৌরনদী উপজেলার টরকীর চর এলাকার সব হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।হিন্দু পাড়ায় এক ভয়ঙ্কর প্রেতপুরী বনে গেলো নিমিষে।উমেশ নিজের আশ্রয় ভিটেতে ছাইয়ের ভস্ম দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো।তার ভিটে পোড়া আগুন তখনও চিতার আগুনের মতো গোঁইয়া গোঁইয়া জ্বলছে।

দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শোষণ,বঞ্চনা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারণাস্ত্রে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্তলোলুপ নরপিশাচেরা। নির্বিচারে তারা হত্যা করে অগণিত মানুষকে। ইতিহাসে এটি ছিল এক বর্বর তম গণহত্যা যে কিনা বাঙালিদের স্তব্ধ করতে পারেনি। একটি তর্জনীর ইশারায় দেশ স্বাধীন হল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এ দেশ ছেড়ে পালালো। তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং বহু ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলাম।দেশ স্বাধীন হলো সত্য কিন্তু বিভার মন শান্তি নেই। চঞ্চল চপলা মেয়েটি আর আগের মতো নেই। তার জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। একটা ঝড় তার জীবনকে তছনছ করে দিলো।চোখ বুজলে সে তাদের এলাকার রাজাকার আইয়ুব আলী বেপারীর দানব মুখ দেখে, রুস্তম শেখের নখের আঁচড় এখনো তার চোখে জল আনে। বিভা রানীর বাবা উমেশ চন্দ্রের চোখে ঘুম নেই। দেশ স্বাধীন হবার ঠিক পরপরই টরকীরচর এলাকার বৃন্দাবন মজুমদারের পুত্র অনুকূল মজুমদারের সাথে মেয়ের বিয়ে দেন উমেশ।বিভা রানীর সতীত্ব হারাবার এ কঠিন নির্মম কাহিনী এলাকার দু একজন মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া আর কাউকে শেয়ার করেন নি উমেশ।এমন কি বিভার স্বামীও জানলেন না সে দিনের সেই ধর্ষিতা হবার নির্মম কাহিনী। বিয়ের পরপরই বিভার পুরো পরিবার নৌকাযোগে শরণার্থী শিবিরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন ভারতে।

দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশ ছেড়ে পালালো। আল বদর,আল শামস, রাজাকার বাহিনীগুলো আত্মগোপনে চলে গেলো।বাংলাদেশের আনাচেকানাচে উড়ছে লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা।দেশ স্বাধীন হবার বেশ কিছুদিন পর বিভা রানী তার স্বামী অনুকূলকে নিয়ে ভারত থেকে টরকীচর গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে ফিরে আসার পরে ঘটে যত বিপত্তি। অনুকূল আস্তে আস্তে জেনে গেলো বিভা রানীর সে অযাচিত কালো দিন গুলির কথা। রাজাকারদের হাতে সম্ভ্রম হারাবার ঘটনাটি কোন ভাবেই অনুকূল মজুমদার মেনে নিতে পারলেন না। শুরু হলও বিভারানীর উপর অমানবিক মানসিক আর শারীরিক নির্যাতন।
-‘পাকিস্তানী কুত্তারা তোরে তুইলা নিয়ে গিয়া রাতভর তোর শরীর ভোগ করছে-তোর বাপ তুই আমার লগে বেইমানি করছস’। বিভা রানী সজল চোখে তার স্বামীর দিকে তাকালেন-‘বিশ্বাস করেন ঐ খানে কোন পাকিস্তানী ছিলো না-ছিলো আমগো গেরামের আইয়ুব আলী, রুস্তম শেখ’।
চুপ আর শুনতে চাই না…।বিভারানী আকাশের দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে লাগলেন। এমন ভাবে সে আকাশের দিকে তাকালেন যেন ঐখানে ভগবান বসে আছেন। আর সে ভগবান নেমে এসে তার স্বামীকে বুঝাবেন।
ছোট বেলায় টরকীচর হাই স্কুলের হেড মাস্টার মশাই একদিন বলেছিল ‘বিভা তুই বড় হলে অনেক বিদ্বান হবি মা।পড়ালেখা একদম বন্ধ করবি না বলে দিলুম-তোর বাবাকেও বলে দিয়েছি’।
আধেক কল্পনা আর পুরানো স্মৃতি মন্থনে বিভারানীর দুচোখ আবার জলে ভরে উঠলো।
সবার জীবনে সুখ সহে না এ বাক্যটি ধ্রূব সত্য।আর ঠিক তারি প্রতিফলন ঘটলো ষোড়শী বিভা রানীর জীবনে। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বিভা রানীর স্বামী অনুকূল মজুমদার বিভাকে একা ফেলে ভারতে চলে গেলেন।একবার ও বললেন না কোথায় যাবেন কিংবা আর ফিরবেন কিনা।তার এ নিরুদ্দেশ যাত্রায় বিভা রানীর জীবন দুঃখের অতল সাগরে তলিয়ে যেতে লাগলো আরেকবার।
বিভা বড্ড ভালোবাসে অনুকূল কে।অনুকূল কে আসল সত্য না বলে সে যে অন্যায় করেছে তার প্রায়চিত্ত করতে চাইলো বিভারানী।কারণ তারও একটা বিশ্বাস ও ধারনা ছিল তার স্বামী অনুকূল ও তাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেলো তার স্বামী ভারতের উত্তর প্রদেশের কোন এক স্থানে রয়েছেন।বিভারানী সতী সাবেত্রী অন্তত নিজের কাছে তার ভগবানের কাছে।ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে চাইলো। যে করে হোক সে তার স্বামীকে খুঁজে বের করবে।সে তার বাবার আশীর্বাদ নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে পথে নামলো। ঝড় বৃষ্টিতে উত্তর প্রদেশে বাসা বাড়িতে ঝি এর কাজ করে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সে তার স্বামী অনুকূল কে খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একদিন সে তার স্বামীকে খুঁজে পেলো। স্বামীকে খুঁজে পেলো সত্য কিন্তু ততোদিনে অনুকূল মজুমদার সবিনয়ে বিভা রানীকে ফিরিয়ে দিলো। এক বুক দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অভাগী বিভা রানী আবার বাবার কাছে ফিরে এলো।
১৯৭৮ সালের কোন এক অলক্ষুণে রাত।বিভা রানী বারান্দায় বসে বিলাপ সুরে কান্না করছে।তার পায়ের নীচের শেষ আশ্রয় স্থল টুকো ও হারিয়ে ফেললেন আজ সকালে।যে বাবা আদর করে তাকে মা সরস্বতী বলে ডাকতো সে বাবা আজ মেয়ের শোকে ধুকে ধুকে মরে গেলো। বিভারানীর দুঃখ শুনে বুকে জড়িয়ে ধরে আর কেউ বলবেনা-‘বিভা কাঁদিস না মা-ভগবান একজনতো আছে সে আমাদেরকে দেখবে- দেখিস একদিন না এক দিন অনুকূল তোর কাছে ফিরে আসবে’।
ছোট ছোট ৪ ভাই বোন নিয়ে বিভা পথে নামলো। আবার শুরু হলও বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে পরাজয় হবে জেনেও বিভারানী হাল ছাড়লেন না।ছোট ছোট ভাই বোনদের দুবেলা অন্ন যুগিয়ে কোন মতে যখন আহত পাখির মতো টেনে হেঁচড়ে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখে চলেছেন ঠিক সে সময়ে হঠাৎ একদিন অনুকূল ফিরে এলেন। তবে এ ফেরা অভাগী বিভা রানীর দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেলো। কিছুদিন বিভার সাথে থেকে অনুকূল মজুমদার আবার ভারতে চলে গেলেন এবং এও বলে গেলেন সে ঐ প্রদেশে আরেকটি বিয়ে করেছেন এবং সে আর কখনও বিভা রানীর কাছে ফিরবেন না। অনুকূলের বিদায়ে বিভা পাথরের মূর্তির মতো অপলক তাকিয়ে রইলেন।
বিভা রানীর স্বামী অনুকূলের প্রস্থান শুধু কি প্রস্থান? অভাগীর দুঃখ আরও বাড়লো বৈ কি। মৃত্যুর তিলক কেটে অনুকূল যেন তার প্রতিশোধ নিলেন। বীরাঙ্গনা বিভা রানীকে উপহার দিয়ে গেলেন এক পুত্র সন্তান। খুব ছোট বেলা যে কিনা ভুল চিকিৎস্যয় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে বেড়ে উঠে। বিভা রানীর ছেলের নাম রাখলেন সাগর। তার চোখের জলে একদিন নদী হয়েছিলো জানি এখন সে নদী আবার সাগর হয়ে তাকে ভাসাতে লাগলো জলেভাসা পদ্মের মতো করে। এক দিকে প্রতিবন্ধী পুত্র সাগর অন্যদিকে বাকি ৪ ভাই বোন।ক্ষুধার রাজ্যে এ নিষ্ঠুর পৃথিবীকে তার কাছে গদ্যময় মনে হয়।একটি কাজের আশায় সে চষে বেড়াচ্ছেন টরকী বন্দরের এপার হতে ওপারে। এমন কোন কাজ নেয় যা সে করেনি। কাঠমিস্ত্রির হেল্পার হয়ে কখনো করাত টেনেছেন কখনো ধাত্রী হিসাবে ছুটে গেছেন মানুষের পাশে। অবশেষে সেলাই শিখে বনে গেছেন সেলাই দিদিমণি।
চারদিকে চুপচাপ নীরবতা।প্রতিবন্ধী সাগর ঘুমিয়ে গেছে সেই কবে।বিভা রানীর চোখে ঘুম নেই। একাত্তরের সেই ভয়াল রাত্রির পর থেকে বিভা রানীর চোখে ঘুম নেই।মাঝে মধ্যে বাবার নাম ধরে কাঁদে আবার মাঝে মধ্যে স্বামী অনুকূলের নাম ধরে কাঁদে। আর যখন ঐ আলবদর, রাজাকারদের হিংস্র দানব মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে তখন বিনা কারণে তার সেলাই মেশিন টা বাঘের মতো গর্জে উঠে।সেলাই দিদিমণি চোখের অনলে সেলাই করে নরপিশাচদের বুক। সেলাই মেশিন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় আর তার দুচোখ বেয়ে ঝরতে থাকে গরম অশ্রু।আর সে অশ্রু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পথ থেকে পথে, নদী হতে সাগরে আর টরকী বন্দর থেকে আটষট্টি হাজার বর্গমাইল লোকপ্রান্তরে।