সেবার চেয়ে দুর্ভোগই যেখানে বেশি

18

মনিরুল ইসলাম মুন্না

মোহাম্মদ আলীর বাড়ি বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি এলাকায়। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি কার্ডে) নিজ নামের একটা শব্দ ও জন্ম তারিখ ভুল হয়। তাই আটকে যায় তার পাসপোর্ট। সংশোধনের জন্য নির্দিষ্ট অংকের ফি দিয়ে আবেদন করেন উপজেলা নির্বাচন অফিসে। কিন্তু সেখানে সমাধান না হওয়ায় তাকে পাঠানো হয় বান্দরবান জেলা নির্বাচন অফিসে। বান্দরবানেও কাজটি সমাধান হয়নি।
কাজের মাত্রা জটিল হওয়ায় তাকে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। শেষে গত ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে আসেন তিনি। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করতে হলে নিতে হয় টোকেন। যার ক্রমিক নম্বর ছিল ২৫। কিন্তু ২৫ নম্বর সিরিয়াল পেতে পেতে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা চলে যান। কারণ ততক্ষণে বিকেল ৫টা অতিক্রম করায় কর্মসময় শেষ হয়ে যায়।
মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার নিজের নাম, জন্ম তারিখ এবং মায়ের নাম এন্ট্রি করতে ভুল করে নির্বাচন কমিশনের নিযুক্ত অপারেটর। তার আগে জন্মনিবন্ধনও করে রেখেছি। সেখানে কোন ভুল ছিল না। তবে পাসপোর্ট রিনিউ করতে গেলে হয় যত ঝামেলা। সংশোধন করতে এক অফিস থেকে অন্য অফিসে ধর্ণা দিতে হচ্ছে। শুধু বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামে এসেছি এ পর্যন্ত তিন বার। এখনও স্যারের সাথে দেখা করতে পারলাম না। অথচ স্যারের সাথে দেখা হলেই আমার কাজটা হয়ে যেত।
এছাড়া সাতকানিয়া থেকে সাজু ধর নামে আরেক ভুক্তভোগী আসেন পোস্ট কোড সংশোধন করাতে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন অফিসে গেলে বলে এটি জেলা অফিসের কাজ। আবার জেলা অফিসে গেলে বলে উপজেলা নির্বাচন অফিসের কাজ। এ পর্যন্ত তিনবার উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে এবং পাঁচবার জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে যান তিনি। কাজপত্র সার্ভারে ইনপুট দিলে একটা সমস্যা চলে আসে, তা হল ইস্যু ইনকমপ্লিট
বিষয়টি নিয়ে কর্মরতদের সাথে কথা বললে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিলের পূর্বে নির্বাচন অফিসের কাজ ছিল ম্যানুয়ালি। পরবর্তীতে করোনা মহামারি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে সকল অফিস আদালত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যায় সরকার। নির্বাচন অফিসের আবেদন ও কার্যক্রমও অনলাইনে সম্পাদন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু তার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে যারা সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলেন, তারাই এ জটলার মধ্যে পড়ে যান। আবেদন যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় রয়ে যায়। কোন পরিবর্তন হয়নি। যার জন্য জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ সংশোধন করতে পারবেন না।
শুধু মোহাম্মদ আলী বা সাজু ধর নয়। প্রতিদিন চট্টগ্রাম নগর, জেলা ও বিভাগীয় এলাকা থেকে সংশোধন করতে আসছেন শত শত মানুষ। আর এত মানুষকে একসাথে সেবা দিতে গিয়ে কর্মকর্তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সরেজমিনে আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, আইডি কার্ডে তথ্য ভুল থাকায় তা সংশোধনের জন্য নির্বাচন অফিসে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এই ভুলের জন্য ইসির কর্মীরাই দায়ী। তাদের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের। কার্ডের তথ্য সংশোধনের জন্য গুণতে হচ্ছে টাকা। সাথে ভোগান্তি তো আছেই। কার্ড সংশোধনে মাসের পর মাস ও অনেক ক্ষেত্রে বছরও লেগে যায়।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, যখন জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কাজ শুরু হয়, তখন ইসির অদক্ষ কর্মীরা তথ্য সংরক্ষরণে যে ভুল করেছেন, সেই কারণে আজকে নাগরিকদের এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
লাইনে দাঁড়ানো নিলু আক্তার অভিযোগ করে বলেন, সকাল ৯টায় আসলেও এখন বিকেল সাড়ে ৪টা। এখনও কাজ করতে পারিনি। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু বসতে চাইলে পিয়ন বলে ‘দাঁড়িয়ে থাকেন। স্যার বের হলে মাইন্ড করবেন।’ তারা সেবা দেয়া তো দূরের কথা, একটু সুন্দর করে কথাও বলছেন না। আমরা এখানে বেড়াতে আসিনি, বিপদে পড়ে এসেছি। কাজ শেষ হলেই চলে যাবো।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন এনআইডি সংশোধন বন্ধ ছিল। পরে গ্রাহকদের সেবা বিবেচনা করে গত বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে অনলাইনে এনআইডি সেবা কার্যক্রম চালু করে ইসি। এখানে ক, খ, গ ও ঘ এই ৪ ক্যাটাগরি করে সংশোধনের জন্য মাঠপর্যায়ের নির্বাচন অফিসারদের সংশোধন দায়িত্ব দেয় ইসি।
ক- ক্যাটাগরিতে থানা নির্বাচন অফিসররা এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার ৬২৮ অবেদন নিষ্পন্ন করেছেন। অনিষ্পন্ন রয়েছে ৫৩ হাজার ৬৯৬ জনের আবেদন। খ- ক্যাটাগরিতে জেলা নির্বাচন অফিসার নিষ্পন্ন করেছেন ৪৭ হাজার ২৫৭ জনের অবেদন, অনিষ্পন্ন রয়েছে ৪৩ হাজার ৭৭৩ জনের আবেদন। এছাড়া গ- ক্যাটাগরিতে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা নিষ্পন্ন করেছেন ২১ হাজার ৪২৭ জনের অবেদন। এই ক্যাটাগরিতে দশ জন কর্মকর্তার কাছে অনিষ্পন্ন রয়েছে ৬৯ হাজার ৪৯ জনের অবেদন। এনআইডি’র মহাপরিচালকের ঘ- ক্যাটাগরিতে নিষ্পন্ন করা হয়েছে মাত্র ৩১২ আবেদন, অনিষ্পন্ন রয়েছে ১ হাজার ২৪৬ জন ভোটারের অবেদন। দেশে বর্তমানে ১০ কোটি ৯৮ লাখ ভোটার রয়েছে। এর মধ্যে অনেক নাগরিকের কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে এনআইডিতে। তারা রাষ্ট্রীয় সেবা নিতে এসে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন। ভোগান্তির যেন শেষ নেই।
এদিকে নাগরিক জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এনআইডি কার্ডে তথ্য ভুল থাকায় সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এধরনের ভুলের কারণে অনেকের চাকরি হচ্ছে না, বেতন পাচ্ছেন না, পাসপোর্ট করতে পারছে না, বিয়ে-শাদিতে কাবিননামা করতে পারছে না, কেউবা ব্যাংকের নিয়মে আটকে টাকাও উত্তোলন করতে পারছেন না। পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় অনেক হতদরিদ্র ভিজিএফসহ বিভিন্ন ত্রাণ নিতে পারছেন না। এ রকম অসংখ্য সমস্যায় সম্মুখীন সাধারণ মানুষ।
নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা বলেন, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা এমনকি কোন কোন সময় রাত ১০টা পর্যন্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। একজন মানুষের পক্ষে এক টানা কতক্ষণ সেবা দেয়া সম্ভব? অনেক সময় উনাদেরও তো বিরতির প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু সেবাগ্রহীতাদের চাপের কারণে তাও সম্ভব হয় না। তবে এখন অনেকটা সহজ হয়েছে। আগে একটা শব্দ সংশোধনের জন্যও ঢাকা যেতে হত। এখন সেগুলো জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও সমাধান করা যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান পূর্বদেশকে বলেন, সকাল ৯টা থেকে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। শুধু এনআইডি সংশোধন নয়, পাশাপাশি অন্যান্য কাজও করতে হচ্ছে। এত মানুষকে সেবা দেয়ার পরও যদি তারা সেবা পায়নি বলে, তবে জীবন দেয়াটায় বাকি মনে হচ্ছে। যারা কাজ সম্পন্ন করে গেছেন তাদের সাথে কথা বলে দেখুন আমরা কীভাবে সেবা প্রদান করেছি।
তিনি আরও বলেন, সেবাগ্রহীতাদের সেবা প্রদান করা আমাদের কাজ। কারও কাজ সহজ, আবার কারও কাজ কঠিন। সেই অনুযায়ী আমাদের সময় ব্যয় করতে হয়। এনআইডি সংশোধনের পাশাপাশি ইউপি নির্বাচন, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয় দেখতে হচ্ছে। এতে আমি বা আমরা চাই না সেবাগ্রহীতারা দুর্ভোগে পড়–ক। এনআইডির বিষয়টি নিয়ে আমরাও দুঃখিত।