সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, স্বপ্নের পদ্মাসেতু

17

 

‘গরীবের বৌ হক্কেলে ভাবী।’ এমন ভাবাপন্ন বা ন্যূনতম ছলসুতো ধরে আটকে দেয়া! আজকাল এ ধরনের এক বাজে স্বভাব পেয়ে বসেছে পরাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে; অবশ্য শিল্পোন্নত দেশগুলোকে খেয়াল রাখতে হবেÑ তৃতীয়বিশ্বের বা স্বল্পোন্নত দেশের মানবিক বিপর্যয় যেন না ঘটে; হ্যাঁ, আস্তে আস্তে তারাও এগিয়ে আসুক। তা হলে মানবসম্পদ উন্নয়নে ক্রমাগত চাপ কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো চিত্র।
২০১২খ্রি. ৯ জুলাই চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় (দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ) প্রকাশিত হয়। ‘পদ্মা সেতুর ফাঁদে সরকার।’ বিশ্লেষণধর্মী এ লেখাতে উল্লেখ করা হয়,‘দুর্নীতির দায়ে পদ্মাসেতুর ঋণের প্রস্তাবনা-চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের এসব কথা খুবই স্পর্শকাতর; বিষয়টি সত্য প্রমাণে অনেকটা এগিয়ে তারা। তাদের ভাষায় Ñ এটি শতভাগ সত্য ঘটনা! তাদের আরেকটি দৃশ্যমান সত্য আছেÑ সেবাখাত হিসেবে এটি নির্মাণ করতে চেয়েছিল, তারা এমন জোর দাবি করে আসছে। তাই তাদের সুদের হার সর্বনি¤েœ, দশমিক পঁচাত্তর শতাংশ। শেষতক সরকার মালশিয়ার বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতে বাধ্য হয়। কিন্তু মালেশিয়ার প্রস্তাবনাঋণের সুদের হার তিন শতাংশ, যা বিশ্বব্যংকের চাইতে অপেক্ষাকৃত বেশী।
কেন সরকার বিশ্বব্যাংককে হারালো জনগণের কাছে এটি এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে; বিশ্বব্যাংকও এ ক্ষেত্রে প্রমাণ করুক তারা জনগণের প্রভু নয় সেবক। তবে, জনগণ কি তা জানে? বিশ্বব্যাংক শর্ত ছাড়া যে ঋণ দেয় না; তাদেরও দুরভিসন্ধি আছে; স্বার্থের হেরফের হলে সঙ্গে সঙ্গে ঋণপ্রস্তাব বাতিল করে দেয়। বাংলাদেশের বেলায়ও-এর ব্যতিক্রম কিছু নয়!
বিশ্বের এককেন্দ্রিক অর্থনীতির প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় রয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের অর্থঋণ যত না সেবা তার চাইতে বেশি রাজনীতি; তাই বিশ্বব্যাংক যাদের বন্ধু নতুন করে তাদের আর শত্রæর প্রয়োজন পড়ে না! তৃতীয়বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। দাতাদের সাথে নতজানু নয়, যুক্তিপথে এগোতে চায়। কিন্তু দাতাগোষ্ঠীর চাপ সামাল দিয়ে টিকে থাকাটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জের বিষয়।’
আমার এ কলামটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘কর্জ বা ঋণ করে ঘি খাওয়ার চাইতে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো সম্মানজনক। সরকার পদ্মাসেতু নির্মাণ করুক জনগণও তা চায়। অন্তত ষাট শতাংশ নিজস্ব তহবিল দিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ করলে সম্পদের সুষম বন্টনসহ স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। শর্তসাপেক্ষে ঋণ নিয়ে দেশকে দেউলিয়াপনার দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না এবং তা জনগণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।’
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, পদ্মা সেতুর পর্দা ওঠতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২৫ জুন আনুষ্ঠানিক সেতুটির দুদিকের দ্বার জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে নানা রম্যরসে ভাসছে দেশ। বিশেষ করে সেতু নিয়ে সরকার প্রধানের বক্তব্যে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়াও শুনা যাচ্ছে। বিবদমান পক্ষগণকে গলাফাটিয়ে বলতে শুনা যায়Ñ কারো ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা হয়নি, রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এ নির্মাণ কাজের মহাযজ্ঞ শেষ হয়। যার ফলে জন চলাচলে আপত্তি থাকতে পারে না; তবে এ কথা শতভাগ ন্যায্য যে পদ্মাসেতু ‘জাতিয় সম্পদ’। এক কথায় সকল নাগরিকের অধিকার জন্মায় এবং দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখবে এটি। দক্ষিণ ও পশ্চিমে এবং বরিশাল, খুলনা, ঠাকুরগাঁওসহ কয়েটি জেলার পণ্যে পরিবহন ও জন চলাচলের সূবর্ণ-সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে উৎপাদিত কৃষিপণ্য ঢাকাসহ দক্ষিণ অঞ্চলে দ্রæত পৌঁছানো যাবে। যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরীঘাটের দূর্বিষহ জানযট হতো এবং সেই পথ মাত্র ১০-১৫মিনিটে পারাপার হওয়া যাবে।
তবে টোল আদায়ে সর্তক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত টোল নিধারণ করা হলে জনগণের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন গুড়ে বালি! তবে মাওয়া ফেরীঘাটের আশপাশের জনবসতি এবং পূর্বের কর্মমুখর অবস্থা বিবেচনায় আনতে হবে। তাদের মানবিক দিকগুলোও দেখতে হবে। অন্যথায় অস্থিতিশীলতা বেড়ে যেতে পারে। কোনভাবেই সৃষ্ট দায় থেকে সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারে না; সব-ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা আরো বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিষয়টি সর্তকতার সাথে দেখভাল করা উচিত, অন্যথায় একটু হেরফের হলে সংঘঠিত হয় রাষ্ট্রদ্রোহীতা! তা হলে বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অর্থনীতিবিদ দেবব্রত ভট্টচার্য্যসহ আরো যাঁরা অনাকাঙ্খিত আচরণ প্রর্দশন করেছেন বলে জোর গুজব শোনা যাচ্ছে; এমন হলে জাতি হিসেবে আমরা মর্মন্তুদ। যা বিশ্বাসের জায়গা সংকোচিত হয়। বুঝতে হবে দেশের উন্নয়ন মানে সামগ্রিক উন্নয়ন। যেখানে বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক) ও জাইকা (জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা) দুর্নীতির অভিযোগে তাদের ঋনপ্রস্তাবনা প্রত্যাহার করে। সেক্ষেত্রে ভাবর্মূতি ক্ষুণ্ন হয় এবং জাতি সঙ্কটাপন্নতার আবর্তে; অতঃপর একজন সচেতন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির আচরণ অধিকতর সংযত হওয়া উচিত। জাতির হৃদগৌরব ও মর্যাদা ফিরে আনতে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অত্যাবশক। আর সেখানে এমন ঊদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ মোটেই কাম্য না। যতই দাতা দেশগুলোর চাপ থাকুক না কেন, সর্ব প্রথম নিজেদের ঘর সামাল দেয়া উচিত। তারপর সমাজনীতি ও রাজনীতি। একটি বিষয় স্মরণে রাখাটা অত্যাবশ্যক, প্রয়োজনে সেখানে নিশ্চুপ থাকাটা শ্রেয় নয় কী? এতে করে নিজেদের জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। অথচ এসকল মহাজ্ঞানীদের ঊদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে আমজনতাও ক্ষুব্ধ। এতে রোষানলে পড়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না! অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষকে একচেটিয়া বাহবা দেয়া মানে একধরনের রাজনীতির অদুরদর্শীতা বলা যায়; এরপরও যে এ কথা না বলাটাই বেরসিক। অথচ কানাডায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের জবাবদীহিতা করতে হয়। এমন কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে এক উর্ধ্বতন কমকর্তাকে দেড় মাস জেল খাটতে হয়। অবশ্য কানাডার ওই আদালতে অভিযোগটি খারিজ করে দিয়ে অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস দেয়। এরফলে পদ্মাসেতুর প্রস্তাবনা ঋণ দুর্নীতি থেকে দায়মুক্ত হয়।
এসবক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিচেক্ষণতার পরিচয় মিলে এবং তিনি ভেঙে পড়েননি দাদা দেশের চাপে। অবশ্য তাঁর সাহসের প্রশংসা করতে হয়। কলামে আমাদেরও পরামর্শ ছিল, ‘পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে হলে নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে।’ সেখানে এ বিশাল অংকের ধকল সহিয়ে ওঠা ইস্পাত কঠিন ছিল। তাই, সর্বশেষ প্রস্তাব ছিল ৬০শতাংশ নিজস্ব অর্থায়নে এবং বাকী ৪০ শতাংশ ঋণের প্রস্তাবনায় প্রারম্ভিক-সূচনা করা। সেখানে শতভাগ নিজেদের অর্থায়নে এ মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করা ছিল চ্যালেঞ্জিং! দেখতে পাচ্ছি সফলতা ফানুস উঠতে, স্বপ্ন নয় বাস্তবে। সমগ্র জাতি নয় শুধু, বিশ্ববাসী আজ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেÑকি করে তা সম্ভব হলো? পদ্মাসেতু দিয়ে শুধু যান চলবে না, ট্রেনও চলবে। সঙ্গে নির্ভরতা, সক্ষমতা ও টেকসই উন্নয়ন ধরে রাখতে হবে।

লেখক : কবি, কলামিস্ট