দীর্ঘ দুই বছর প্রায় অতিমারি করোনায় ব্যাপকভাবে মানবিক বিপর্যয়ের পরও প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিত্যপণ্যের বাজার। সবশ্রেণি পেশার সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা কষ্ট কোন কিছুই অসাধু ব্যবসায়ীদের মন গলাতে পারছেনা। বরং দিনের পর দিন সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছেন তারা। এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো একটু নড়েচড়ে বসলেও পরক্ষণে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু সাধারণ ভোক্তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়না। তাদের ভোগান্তি আর দীর্ঘশ্বাস বাড়তেই থাকে। অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সম্প্রতি ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কূশিলবের ভুমিকায় ছিল অসাধু ব্যবসায়ীদের কথিত সিন্ডিকেট। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, তারা বিগর দুই বছর ধরে সব নিত্যপণ্যের একসাথে দাম না বাড়িয়ে একেকটি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে জনদূর্ভোগের মাত্রায় ঘি ঢালছে। আর যখনই বাঙালির উৎসব, ধর্মীয় আবেগের মাস রমজান, ঈদ শুরু হয় তখন একসাথে আগুন ছড়ানো হয়। এ পণ্যমূল্যের আগুন নেভাতে হবে, আগুনদাতা ও ইন্ধনদাতা সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায়ও আনতে হবে। এ দায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। গত রবিবার ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে সংক্ষুব্ধ এক আইনজীবীর করা রিট আবেদনের শুনানিকালে এসংক্রান্ত গঠিত ব্যাঞ্চ বলেন, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির দায় অসাধু সিন্ডিকেটের। যারা দ্রব্যমূল্য কুক্ষিগত করে রেখে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলে, সেই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। এসময় আদালত রিটকারী আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, সামনে রমজান মাস আসছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারে অসাধুচক্র। শুধু সয়াবিন তেল নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের কথা রিটে অন্তর্ভুক্ত করুন। এমন আদেশ দিতে হবে যেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উপকার হয়। টিসিবির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণে নীতিমালা করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
এর আগে গত ৬ মার্চ সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং সেল গঠন এবং নীতিমালা তৈরি করতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবীর। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল প্রতিকার চাকমা। এদিকে নিত্যপণ্যের ওপর ভ্যাট-শুল্ক কমানো এবং সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে দুই একদিনের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। রবিবার সচিবালয়ে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি ও বাজার পর্যালোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। এসময় মন্ত্রী পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া বন্ধে টাস্কফোর্স কাজ করবে জানিয়ে তিনি অস্বাভাবিক দাম নেওয়া বন্ধে প্রয়োজন অনুযায়ী ‘অ্যাকশনে’ যাওয়া ও তদারকি বাড়ানো এবং অবৈধ মজুত বন্ধে ‘হস্তক্ষেপ’ করার কথাও জানান। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সুযোগ নিয়ে কোনো অসাধুতা যেন প্রশ্রয় না পায়। এ জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করতে। আমরা দু’এক দিনের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করব, যাতে কেউ সুযোগটা না নিতে পারে। বিভিন্ন জিনিসের সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, কেউ তার চেয়ে বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা অতীতেও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নরম-কঠোর সিদ্ধান্তের কথা শুনেছি, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর খুব একটি দৃশ্যমান নয়। আমরা মনে করি, হাইকোর্ট রবিবার যে আদেশ দিয়েছেন এবং আজ সোমবার যে আদেশ দিবেন, তা যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। সিন্ডিকেট ভেঙ্গে বাজার মনিটরিং জোরদার করে বাজার নিয়ন্ত্রণ আনা অসম্ভব কিছু নয়।
একইসাথে বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘœ রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা এও মনে করি, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত- এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া প্রতিদিনই বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে সরকারি সংস্থাগুলোর উচিত পণ্যেমূল্যের তালিকা প্রস্তুত করা। সামনে রমজান, দেখা যাবে রমজানে সব সংস্থা বাজারে নেমে তড়িগড়ি করে বাজারদর নির্ধারণ করে মূল্য তালিকা টাঙানোর তাগিদ দেবে। আমরা বলতে চাই, সময়ে এক ফোঁড় অসময়ে দশ ফোঁড়। সময় থাকতে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এতে জনদুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে।