সাহস ও ত্যাগের অনন্য প্রতীক

33

মোখতার আহমদ, আমাদের মোখতার ভাইয়ের সাথে ছাত্রলীগ করতে করতেই পরিচয়। তবে কোথায় কখন এই পরিচয়ের সূত্রপাত আমি স্মরণ করতে পারছি না। সম্ভবত তিনি ১৯৬৬ সালে যে সম্মেলনে অবিভক্ত ছাত্রলীগের সভাপতি হন তার পর থেকেই ঘনিষ্ঠতা। তিনি জেলা ছাত্রলীগের নেতা হলেও আমরা শহর ছাত্রলীগের যারা স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতাম কথা বলতাম তিনি আমাদের সাথে থেকে আমাদের কাজের নেতৃত্ব দিতেন। তখন হরতালের দিনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ছাত্রলীগের একটি দল আমরা জড়ো হতাম। সারা রাত মলোটভ ককটেল বানাতাম পরদিন হরতাল সফল করার জন্য। হরতাল পালনে মোখতার ভাই আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। জেলার কাজের বাইরেও তিনি শহরের আমাদের সাংগঠনিক কাজে সহায়তা করতেন। একবার চট্টগ্রাম গার্লস কলেজে আমরা যাই ছাত্রলীগ গঠন করতে। আমার ছোট বোন আনার তখন সে কলেজের ছাত্রী। আমি ও মোখতার ভাই সভা করার জন্য প্রিন্সিপালের অনুমতির জন্য যাই। প্রিন্সিপাল রেগে আগুন। তিনি অনুমতি দিলেন না। মোখতার ভাই আমাকে বললেন, মাহফুজ , ১৫ দিনের ভিতর তুমি গার্লস কলেজে ছাত্রলীগ গঠন করে প্রিন্সিপালের কথার জবাব দিবে। উনাকে নিয়ে গার্লস কলেজের সামনে হায়দার ভাইয়ের বাসায় পর পর তিন/চারটি সভা করলাম। গার্লস কলেজে ছাত্রলীগ গঠিত হলো। এর কৃতিত্ব মোখতার ভাইকে দিতেই হয়। এর মাঝে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ৬৯ সালে মোখতারভাই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি। এ গণআন্দোলনে অনেকের সাথে মিলে তিনি নেতৃত্ব দেন। এর আগে ৬৬ সালে থেকেই তিনি নিউক্লিয়াসের সদস্য। আমি জেনেছি ১৯৬৭ সালে। এই সময়ে তিনে চট্টগ্রাম বৃহত্তর জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হন। এরপর ৭০ সালের আন্দোলন, ৭১ সালের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ৭১ সালের সম্ভবত ১৮ মার্চ আন্দরকিল্লা বন্দুকের দোকান লুট করার সময় আমাদের সাথে ছিলেন। আমি ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন গুদামের ভিতর থেকে অস্ত্র বের করছি , ফাহিউদ্দিন গ্রিলের পাশে থেকে অস্ত্র নিয়ে অন্যান্যদের সহায়তায় জমা করছে আর মোখতার ভাই সেখানে থাকা পুলিশদের সাথে গল্প করছেন। উদ্দেশ্য পুলিশকে তাদের কাজ থেকে বিরত রাখা। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যান এবং দক্ষিণ জেলার এফ এফ কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি যৌথ বাহিনীর অনুরোধে ফটিকছড়িতে যুদ্ধ করেন। মোখতার ভাই ছাত্র রাজনীতি করেছেন একটি সামান্য চাকরির আয় থেকে, বেসরকারি চাকরি। এই ব্যাপারে তার স্ত্রী সহযোগিতা করতেন।
স্বাধীনতার পর জাসদে যোগ দেন। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে সরকারি সব সুযোগ সুবিধা ছেড়ে জাসদ রাজনীতিতে ঢুকে তিনি ত্যাগ ও সাহসের পরিচয় দেন তা সত্যিই অনন্য। জাসদ রাজনীতিতেও তিনি আমাদের অনেকের সাথে মিলে ব্যতিক্রমী ভূমিকা নেন। জাসদের হটকারী বিভিন্ন কাজ থেকে চট্টগ্রামকে দূরে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। পরে এরশাদ আমলে তিনি এমপি হন। বাংলাদেশের যে কয়েকজন এমপি আগাগোড়া দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন এবং আছেন নিঃসন্দেহে মোখতার ভাই তার অন্যতম। পরে তিনি আওয়ামী লীগে আবার ফিরে যান। অর্থাভাবে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান।
একটি শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ছিল মোখতার ভাইয়ের স্বপ্ন । আমাদের সবার উচিত সেই বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রেখে মোখতার ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।

লেখক : ষাট দশকের ছাত্রলীগ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা