বিশ^ ভুবনের একমাত্র প্রভু পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপালন করেন। সকল কিছুর মূল উদ্দেশ্য হলেন তিনিই। সকল সৃষ্টির মূলে তিনিই। তাঁর সৃষ্টি যেমন মহান, তাঁর সৃষ্টির মাঝে উদ্দেশ্যও মহান। তাঁর এ মহান উদ্দেশ্যেও প্রতিফলন হলো তাঁর প্রিয়তম মানবসৃষ্টি। মানবসৃষ্টির মৌলিকত্ব হল উবুদিয়্যত; যা পবিত্র কোরআনের অখন্ডিত সুনিশ্চিতভাবে বর্ণিত, আমার এবাদত (গুণকীর্তন) করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি (৫১ঃ৫৬)। সৃষ্টির সফলতা অর্থাৎ সৃষ্টির সৌন্দর্য তখনই বিকাশমান হয়, যতদিন সৃষ্টি স্রষ্টার উদ্দেশ্যকে যথাযথ প্রতিফলন ঘটায়। মহান প্রভুর তাঁর সৃষ্টির সাথে এক অভিনব, অতুলনীয় ও রহস্যপূর্ণ প্রণয় সংশ্রবী বন্ধন রয়েছে। তাকালের দূরত্বে আলমেনাছুতবা দৃশ্যত জগতের মহাঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ প্রলোভন ও নফসানিয়্যতের মোহে সেই বন্ধনে আবরণের কঠোরতা গ্রাস করে ফেলে,তাই যুগ যুগান্তরে ঐ পরিচিত জ্ঞান ও প্রেম প্রীতিময় বন্ধনকে উন্মোচনে, তাঁর সুমধুর শান্তিময় পবিত্র মিলন ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, তাঁর মনোনীত নবী ও অলিরা পথভ্রান্ত মানবদের একমাত্র প্রদর্শক ও উন্মোচক। তাই হাদিস দর্শনে ‘মোজাদ্দিদ’ তথাযুগ-সংস্কারকের আবির্ভাবের কথা বিশুদ্ধ হাদিসেও রয়েছে।
প্রাণোত্তম বিশ^ রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানের পর থেকে আজ অবধি যুগের চাহিদানুযায়ী তথা বিভিন্ন সংস্কারক মহান আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত সংস্কার কার্য করেছেন। কালের দূরত্বে মানব বিভিন্ন সভ্যতার কঠিনতম প্রলোভনীয় ও চিত্তাকর্ষক পার্থিবতার সব নব্য কৌশলের ক্রিয়ার ন্যায়, চিরসত্য, প্রেমময় ও খোদা তত্ত¡জ্ঞানী ভাবধারা থেকে বিচ্যুত মানবকূলকে তাঁরায় স্মৃতি, প্রীতি ও প্রেম প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তাঁর মহা মিলন পথে পৌঁছে দেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, এক মহান আলোকবর্তিকা তৌহিদ পথের অদ্বিতীয় বাহক,মিলনদ্বার ও উদ্ঘাটক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মোজতাবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতীক ও নায়েব আহমদী বেলায়ত ক্ষমতার ঝান্ডাবাহী বিশ্বজনীন বৈষম্যহীন সুফি বা আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী হযরত মওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কাদ্দাসাসির রাহুল আজিজ) এর আবির্ভাব ঘটে। তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব সবখানে দৃশ্যে ও অদৃশ্যে পরিলক্ষিত। তাঁর আদর্শ ভাবধারাও নির্দেশিত মৌলিক পন্থা অনুসরণ করে মানব সমাজ পঙ্গপালের মতো ছুটে এসে ঐ ঐশীমিলনে একীভূত হয়।
যুগ যুগান্তরে যত সংস্কারক এই মানব সভ্যতায় বিকাশ লাভ করেন, তাঁরা যুগের পার্থিব সকল নিত্যনতুন নাছুতী স্বভাব, রিপু ও ইন্দ্রিয় জালের বিপরীতে বিভিন্ন ও অভিনব ধর্মীয় নির্যাস মিশ্রিত উছুল বা পন্থা দ্বারা সত্য পথের দিশা দান করেন,যা সর্বদা সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। এই দিশা সমূহকে সুফি ভাষায় তরিকত বলা হয়। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (ক.) এর প্রদর্শিত পথ বা তরিকা ও অন্যান্য তরিকা সমূহের মত সময়োপযোগী। ঊনবিংশ শতাব্দী যেমন বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বা রূপান্তরের জন্য বিখ্যাত তেমনি এই শতাব্দীতে বিভিন্ন সা¤্রাজ্যেও পতন ও মানব সভ্যতা অধঃপতনও পরিলক্ষিত। এই পতিত মানবকূল নফসে আম্মারা দ্বারা পরিচালিত হয় যা কুকর্মকে নির্দেশ দেয়। কোরআনে আছে, ‘ইন্নান নাফছাল আম্মারাতুন বিসসুয়ে’ (অপরিশুদ্ধ সত্তা মন্দ কর্মের নির্দেশক)। এই অপরিশুদ্ধ সত্তাকে মুক্তির লক্ষে মাইজভান্ডারী তরিকার নির্দেশিত উছুলেছাবয়া তথা সপ্ত পদ্ধতি কষ্টি পাথরের মতো। মহামহিম স্রষ্টার অবিনশ্বর বাণীর ‘ক্বাদ আফলাহামান যাক্কাহা’ (যে নিজেকে শুদ্ধ করেছে, সে সফলকাম) ইশারা এই তরিকার মূল নির্যাস। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (ক.) কর্তৃক প্রদর্শিত ও প্রবর্র্তিত এ সপ্ত উছুল সকল মানবকূলকে বৈষম্যহীনভাবে স্রষ্টার নৈকট্য ও ঐক্যের মোহনায় ঐক্যবদ্ধ করে।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই তরিকার প্রভাব এই উপমহাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া,আফ্রিকা মহাদেশ সমূহে ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। মাইজভান্ডারী তরিকার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোতে এক অবিনশ্বর আবেদন রয়েছে, তাই সকল শ্রেণির ও ধর্মের মানুষ নিজেদের পরিশুদ্ধ করণে এতে সামিল হতে পারে।
আধুনিক সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কৌশলে যেমন যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে, মানুষের ভোগ-বিলাস, পার্থিব মোহ, অন্যায়-অবিচার, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, লুণ্ঠন-হরণ ও ব্যাভিচারের হারও ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানব সমাজ এসব শয়তানী বা নফসের প্ররোচনায় পর্যদুস্ত হয়ে মানসিক শক্তি ও ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে। আধুনিক সভ্যতার এই অবক্ষয়ের প্রতিকার রয়েছে মাইজভান্ডারী তরিকার এই সপ্ত উছুল বা পদ্ধতিতে। এই মহান সংস্কারকের নির্দেশিত পথে মানুষ নিজেকে পরিচালিত করে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল হয়ে মহানপ্রভু কর্তৃক ঘোষিত খলিফা বা প্রতিনিধি করে তুলতে পারবে। এছাড়া এই আধুনিক সভ্যতায় মানুষ পূর্বেকার তুলনায় অনেকবেশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, যা অনেক গবেষণায় ফুটে উঠেছে।আধুনিক বিশ^ সভ্যতার অতি আধুনিকতাকে এর জন্য দায়ী করা হয়। ঐসব গবেষণায় স্রষ্টার সাথে সম্পর্কিতদের ব্যাপারে মানসিক শক্তির বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা তুলে ধরা হয়।
মানবসভ্যতার এই ক্রান্তিলগ্নে মাইজভান্ডারী তরিকা একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে আলোর পথ দেখাবে, যা রিপুর বিনাশ সাধন পদ্ধতির নিরিখে শুরু হয়ে আধ্যাত্মিক মৃত্যু পদ্ধতি সাধনের মাধ্যমে উন্নততর মানবরূপে গঠন করবে।গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর (ক.) কালজয়ী দর্শন উছুলে ছাবয়া তাঁরই সাজ্জাদানশীন হযরত মওলানা শাহ্ ছুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (ক.) বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন।
ক. ফানা আনিলখাল্ক : অর্থাৎ- সৃষ্টির প্রতি আত্মনির্ভরশীল হওয়া। এটি মানুষকে আত্মনির্ভর করে সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে। খ. ফানা আনিল হাওয়া: অনর্থক সব কিছু পরিহার করা। কুচিন্তা, সংকীর্ণতা, সন্দেহ-সংশয়, কু-ধারণা সহ সকল অপ্রয়োজনীয়তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা হয়। গ. ফানা আনিল এরাদা : নিজের ইচ্ছার ওপরে স্রষ্টার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া, স্রষ্টার উবুদিয়্যত ও খিলাফতের শরাফত ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া। কল্যাণের তরে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেকে রূপান্তরিত করে সকল জাগতিক বিচ্যুতিকে অকল্যাণ জ্ঞান করে নিজেকে পরিপূর্ণ মানব করে গড়ে তোলা। এই রিপু বিনাশ পদ্ধতি মানব সমাজকে পূর্ণ শান্তিময় করে তুলতে পারে।
মানব সভ্যতার মুক্তির জয়গানের রূপরেখার দ্বিতীয় পদ্ধতি আধ্যাত্মিক (রূপক)মৃত্যু। মাইজভাÐারী তরিকায় পরিশুদ্ধি করণে নিজেকে আধুনিকতার বৈরী প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পেতে এই মৃত্যু পদ্ধতিতে বিকশিত হবে। এই তরিকায় আধ্যাত্মিক মৃত্যুকে বিভিন্ন রং সংশ্লিষ্টতায় ভিন্ন ভিন্ন রূপক অর্থে প্রকাশ করা হয়েছে যা মানুষের আত্মার ব্যাধির সাথে ইঙ্গিতপূর্ণ। ক. মউতে আবয়্যাজ বা সাদা মৃত্যু : এই মৃত্যু উপবাস ও আত্ম সংযমে আয়ত্ব হয়। সকল আউলিয়া, ঋষি-মনিষীরা আত্মোন্নয়ন এর চর্চা করতেন। সকল কু-বিষয়াদি থেকে আত্মসংযম করতেন। খ. মউতে আছওয়াদ বা কালো মৃত্যু : ইহা অপরের শত্রæতা ও সমালোচনার কারণ আপনার মাঝে খুঁজে আপনাকে সংশোধনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। সমালোচনা বা নিন্দাকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করে তা হাসিল করতে হয়। গ. মউতে আহ্মর বা লাল মৃত্যৃ : ইহা কামভাব ও লোভ লালসা থেকে সংযমের মাধ্যমে অর্জিত হয়। ঘ. মউতে আখজার বা সবুজ মৃত্যু : ইহা বিলাসিতা ও সকল অনর্থক অভ্যাস পরিহাওে নির্বিলাস জীবন যাপনে অর্জিত হয়।
এই সপ্ত কোরআনী পদ্ধতি মানবের মৌলিক চরিত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে,যা মহান আল্লাহর প্রিয়তম বন্ধু হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর (ক.) প্রবর্তিত তরিকায় নির্দেশিত। সেই শতাব্দীকাল আগে থেকে এই মহান পুরুষের দরবার বিশ্বসভ্যতাকে লাইট হাউস হিসেবে সুপথ ও মুক্তির দিকে আহবান করছে এবং দীক্ষা দিচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা তাঁর বর্তমান উত্তরাধিকারী গদীনশীন ও আওলাদ হযরত মওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ.) কর্তৃক এখনো বলবৎ রয়েছে, যাতে অগণিত দিশেহারা মানুষ পথের দিশা পাচ্ছে।
সার্বজনীনভাবে উছুলে ছাবআ বা সপ্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে সমকালীন সমাজ-রাষ্ট্রের নানা সংকটে বিপথগামী তরুণ প্রজন্মেও জন্য এটি মুক্তির অন্যতম পাথেয় হতে পারে। আগামিকাল ১০ মাঘ ২৪ জানুয়ারি এই মহান তরিকার পথিকৃৎ গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী হযরত মওলানা শাহ্সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এর বেছাল বার্ষিকীতে তাঁর প্রতি লাখো সালাম।
লেখক: প্রভাষক, গ্লোবাল ইংলিশ কলেজ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
রিসার্চ ফেলো, দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট