সরকারের পদত্যাগ ও খালেদার মুক্তি দাবি

42

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশে পলোগ্রাউন্ড মাঠ রীতিমতো জনমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এই সমাবেশ বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে নতুন আশা ছড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে। সমাবেশ থেকে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং অচীরেই সরকারের পদত্যাগ হবে বলে নেতারা বার্তা দিয়েছেন। নিরাপদে সরকারকে দেশ ত্যাগের পরামর্শও দিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে প্রধান অথিতির বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শেখ মুজিবের ভাষায় বলতে চাই, গত ১৪-১৫ বছর ধরে এই সরকার পুরো দেশকে শ্মশান করে দিয়েছে। আমরা জানতে চাই, বাংলাদেশ আজকে শ্মশান কেন? এই শ্মশানের কারণ, আওয়ামী লীগ দানব, শেখ হাসিনা দানব। যারা আজকে আমাদের চোখের সামনে সবকিছু লুট করে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। আর আমাদের মানুষকে গরীব করে রেখে যাচ্ছে। আজকে আমরা চাল, ডাল ও তেলের মূল্য কমানোর জন্য সংগ্রাম করছি। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর জন্য লড়াই করছি।
গতকাল বুধবার বিকেলে নগরের পলোগ্রাউন্ড মাঠে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্রের জন্য আবারও যুদ্ধ করতে হবে। এই লড়াই খুব বড় লড়াই। এই লড়াইয়ে হয় জিতব, না হয় মরব। সরকারকে হটানো শুধু বিএনপি বা জাতীয় পার্টির প্রশ্ন নয়, সমগ্র জাতির প্রশ্ন। অস্তিত্বের প্রশ্ন, বেঁচে থাকার প্রশ্ন। আমরা যদি প্রতিবাদ করতে না পারি, তাহলে স্বাধীনতা হারাব, গণতন্ত্রও ফিরে পাব না। এই অবৈধ সরকারকে যদি হটাতে না পারি, তাহলে আমাদের উপনিবেশ হিসেবে থাকতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেছেন, আজ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। দিনে দুপুরে ডাকাতি হয়। মা-মেয়েদের কোনো সম্ভ্রম রক্ষা হয় না। মানুষকে হত্যা ও গুম করা হয়। এমন একটা অবস্থায় এসেছি, যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। শুধু র‌্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দিলে হবে না, হাসিনা সরকারকে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। শেখ হাসিনাকে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। কারণ হাসিনা সরকারের নির্দেশে গুমের ঘটনা ঘটেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। টর্চার করে মানুষকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে।
ফখরুল বলেন, কত টাকায় চাল দেবে বলছিল, শেখ হাসিনা মনে আছে! ১০ টাকা না, আজকে কত দাম ৭০ টাকা। প্রত্যেক জিনিসের দাম ৫ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আবার শুনতে পাচ্ছি, বিদ্যুতের দামও নাকি বাড়াবে। তিন-চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে তারা। দাম বাড়ার কারণ একটাই, জনগণ থেকে চুরি করে ডাকাতি করে বিদেশে পাচার করে কানাডায় বেগম পাড়ায় বাড়িঘর তৈরি করা।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, শতকরা ৪২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। কোন মানুষের নিরাপত্তা নাই। মা-বোনদের কোনো সম্মান দেওয়া হয় না। অনেকে বলেছে নিজেরা লুকিয়ে আছে, গুমের ঘটনা ঘটেনি। জাতিসংঘ পরিষ্কার করে বলেছে, মানবাধিকার কমিশন বলেছে, বাংলাদেশে গুম হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দিন আগে ৭৪ পৃষ্ঠার রিপোর্ট বের হয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার নাই। এখানে গুম হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয়, এমনকি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নাই। বেগম খালেদা জিয়াকে যে সাজা দিয়েছে এটি রাজনৈতিক সাজা বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকার জন্য তাকে সাজা দিয়েছে। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ৩৫ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে।
এই নির্বাচন কমিশনকে ডিসিরাও মানে না উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, কয়েক দিন আগে ডিসি-এসপিরা নির্বাচন কমিশনকে বলেছে আমরা আপনার কথা মানি না। শেখ হাসিনার কথা মানি। এ রকম নির্বাচন কমিশন দিয়ে কোনোভাবেই নির্বাচন নয়। এখানে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। তাই আমরা খুব পরিষ্কার করে বলেছি, সেই কারণে আন্দোলন শুরু করেছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে একটি পার্লামেন্ট গঠন করা হবে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার হবে সব দলগুলো সঙ্গে নিয়ে জনগণের পার্লামেন্ট। সব দল বলতে যারা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে তাদের নিয়ে হবে। আমরা এই কথা বলতে পারি, সেই সরকার গঠন করা হলে, আমরা এই দেশে যত সমস্যা আছে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করবো। চাল, ডাল, তেল বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করবো। বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা করবো।
তিনি বলেন, ‘আমরা সেই বাংলাদেশ চাই। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা ১৯৭১ সালে দেখেছিলাম। যার স্বপ্ন জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া দেখেছিলেন। শেখ হাসিনা আপনি পদত্যাগ করেন। আজ থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেই অন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেবো। সেই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এই সরকারকে অবশ্যই পতন ঘটাবো এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবো।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নেত্রী আজ বন্দি। তিনি ঠিকমত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তারা আমাদের ভয় দেখান আমাদের নেত্রীকে আবার জেলে পাঠাবেন। আসলাম চৌধুরী ছয় বছর ধরে জেলে আছেন। এরা বিচারবিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাবকে দলীয়করণ করেছেন। আজ সারাদেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ আর ছাত্রলীগের কর্মীরা জনগণের পকেট কেটে বিদেশে পাচারে সহযোগিতা করছে।’
সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার আমাদের নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসতে পথে পথে বাঁধা দিয়েছে। হামলা করেছে, গাড়ি ভাঙচুর করেছে। কিন্তু সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আজকের সমাবেশকে জনতা মহাসমাবেশে পরিণত করেছে। সরকারের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এই সরকার আমাদের ৩৭ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। গুম, খুন, বিনা বিচারে হত্যা করেছে। তারপরও একজন কর্মীও বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়নি। সরকার বিএনপিকে দমাতে পারেনি।
তিনি বলেন, এই সমাবেশ থেকে শেখ হাসিনার পতনের সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এদেশে যতবার গণতন্ত্র সংকটের মুখে পড়েছে জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মীরাই সেই সংকট থেকে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন। এদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এই চট্টলা থেকে ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। আজ দেশে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আমরা আজ আবারও যুদ্ধে নেমেছি।
গয়েশ্বর বলেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদেরকে আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে। সেই যুদ্ধ এই সরকার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সংবিধানে কোথায় লেখা আছে সমাবেশ করতে পারবে না। পুলিশ ভাইদের বলব, সার্ভিস রুলস মেনে চাকরি করেন। কারণ আপনারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মচারী নন আপনারা।
তিনি বলেন, জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের আজ আর যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। ভাতের জন্য মানুষ আজ হাহাকার করছে। ভাত দিতে পারবেন না, বিদ্যুৎ দিতে পারবেন না, ক্ষমতায় থাকবেন কেন? শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের প্রধানমন্ত্রী না। চোরের স্বভাব যায় না। সুযোগ পাইলে করে চুরি। তাই এ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন আমরা মানি না।
স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম থেকে শেখ হাসিনার পতন শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামবাসী ডাক দিয়েছে, তাহলে আর দেরি কিসের। শেখ হাসিনা আপনি ক্ষমতা ছাড়ুন, পদত্যাগ করুন।
তিনি বলেন, গণসমাবেশে জনগণ যে রায় দিয়েছেন, তারপর একদিনও ক্ষমতা থাকা অবৈধ। আমরা জীবন দেওয়ার জন্য তৈরি। জীবন দিয়ে গণতন্ত্র আনব, সরকারের পতন ঘটাব। নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন হবে। জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। জনগণের ভোটে সরকার ক্ষমতায় যাবে।
খসরু বলেন, শেখ হাসিনার বিদায়ের পালা এসে গেছে। চট্টগ্রাম মানুষ গণসমাবেশে বুঝিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রামের মাটি বিএনপির ঘাঁটি। আজকের জনসভার পর সারাদেশে যে বার্তা যাবে, সেটি হচ্ছে এখনই পদত্যাগ করেন। আগামীকাল, পরশু নয়, এখনই পদত্যাগ করেন।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সরকার খালি উন্নয়নের কথা বলে। এত উন্নয়ন উন্নয়ন করেন, এই উন্নয়ন তো এখন বাংলাদেশের মানুষের গলার ফাঁস হয়ে গেছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশে খালেদা জিয়ার সরকার চলবে। যারা খালেদা জিয়াকে আবার কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। চট্টগ্রাম থেকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হলো।
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহবায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের দেওয়া বক্তব্যের উদ্বৃতি করে বলেন, একজন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখাতে ভারতের সহযোগিতা চায়। আর একজন বলেন পুলিশ হচ্ছে আওয়ামী বান্ধব। পুলিশ না হলে আওয়ামী লীগ এতোদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতো না। তাদের এই বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের আর কোন রাজনীতিই থাকে না। ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকরাই এখন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করছে। আজকের সমাবেশ প্রমাণ করেছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নাই।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ানের পরিচালনায় সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, চেয়ারর্পানের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়নাল আবেদীন ফারুক, গোলাম আকবর খোন্দকার, ভিপি জয়নাল আবেদীন, এসএম ফজলুল হক, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহাবুউদ্দীন খোকন, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, মৎসজীবী সম্পাদক লুৎফর রহমান কাজল, কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দীন টুকু, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক জালাল উদ্দীন মজুমদার, ভিপি হারুনুর রশীদ, সহ গ্রাম সরকার সম্পাদক বেলাল আহমেদ, সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম মজনু, কেন্দ্রীয় শ্রমিকদলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, কৃষকদলের সভাপতি জাফিরুল ইসলাম তুহিন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানী, সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, তাঁতীদলের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য সাচিং প্রæ জেরী, আলমগীর মাহফুজ উল্লাহ ফরিদ প্রমুখ।